শিরোনাম
// এনামুল হক এনা //
পটুয়াখালী, ২৮ মার্চ ২০২৫ (বাসস): কালে কালে বিভিন্ন মুসলিম শাসক এই দেশ শাসন করেছেন। তাদের শাসনামলেই তৈরি হয়েছে মসজিদ, প্রাসাদ, দুর্গ, কূপ, সেতুসহ নানা স্থাপনা। তার মধ্যে অন্যতম আকর্ষণীয় ছিল বাহারি কারুকার্য সম্বলিত মসজিদগুলো। সেসময় প্রার্থনাসহ, দরবার-শালিস সব কিছুই ছিল এই মসজিদকেন্দ্রিক।
এমনই এক ঐতিহ্যবাহী মসজিদ প্রায় ছয়’শ বছরের পুরাতন পটুয়াখালীর মজিদবাড়িয়া শাহী মসজিদ। জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণে মজিদবাড়িয়া গ্রামে অবস্থিত মসজিদটি বৃহত্তর বরিশালের প্রাচীনতম মুসলিম স্থাপত্যের একমাত্র নিদর্শন। অসাধারণ স্থাপত্যশৈলী ও নিপুণ কারুকার্য খচিত প্রাচীন মসজিদটি প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছরের ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে।
এক গম্বুজ বিশিষ্ট মজিদবাড়িয়া শাহী মসজিদ ১৫ শতকে নির্মিত হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক এই নিদর্শনটি বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলের প্রথম ইটের ভবন। যা সুলতান রুকনুদ্দিন বারবক শাহের শাসনামলে নির্মিত হয়। জানা যায়, ব্রিটিশ শাসন আমলে সুন্দরবন এলাকার জঙ্গল পরিষ্কার করার সময় এই মসজিদটির সন্ধান পাওয়া যায়। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরেই স্থানীয়দের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা ছিল যে, মসজিদটি মাটির নীচ থেকে অলৌকিকভাবে পাওয়া গেছে। ১৯৬০ সালে মসজিদটি মানুষের নজরে আসে।
মসজিদটির নামানুসারেই স্থানীয় গ্রাম ও ইউনিয়নের নামকরণ করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের অভাবে ধ্বংস হতে বসেছে এই মসজিদ। হারাতে বসেছে তার সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য।
মসজিদের শিলালিপি অনুযায়ী, সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের পুত্র রুকনউদ্দিন বারবক শাহের শাসনামলে তার মন্ত্রী খান-ই-আজম উজায়ের খান ১৪৬৫-৬৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এই মসজিদ নির্মাণ করেন। উল্লিখিত শিলালিপিটি বর্তমানে কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটি জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে বলে জানা যায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, আকর্ষণীয় নির্মাণশৈলী ও কারুকার্যখচিত মজিদবাড়িয়া শাহী মসজিদ নির্মাণে চুন-সুরকি ও পোড়ামাটি ব্যবহার করা হয়েছে। মসজিদটির দৈর্ঘ্যে ৪৯ ফুট এবং প্রস্থ ৩৫ ফুট। এছাড়া পূর্ব দিকে রয়েছে সাড়ে ২১ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৮ ফুট প্রস্থের একটি বারান্দা।
মসজিদটির প্রধান কামরা বর্গাকারে নির্মিত এবং প্রত্যেকটি সাড়ে ২১ ফুট লম্বা। মসজিদের দেয়ালগুলি প্রায় সাড়ে ৬ ফুট চওড়া। মসজিদের পূর্ব দিকে ৩টি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে ৪টি করে দরজা।
পশ্চিম দিকের দেয়ালে ৩টি মেহরাব আছে। প্রধান কামরার উপরে আছে আধা গোলাকৃতির একটি সুন্দর বিরাট গম্বুজ। বারান্দার ছাদ চৌচালা ঘরের আকারে নির্মিত।
মসজিদটির প্রধান কামরার ৪ কোনায় ৪টি এবং বারান্দার ২ কোনায় ২টি মিনার আছে। মসজিদের পাশেই রয়েছে এক বিশাল দীঘি। মসজিদের দক্ষিণ পাশে আছে ইয়াকিন শাহ ও কালা শাহের কবর। এছাড়া মসজিদের দক্ষিণ-র্পূব পাশে রয়েছে আরো দুটি কবর।
বরিশাল জেলার ইতিহাস পাঠে জানা যায়, এক সময় বরিশালের প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় নাম ছিল চন্দ্রদ্বীপ। তখনকার চন্দ্রদ্বীপে নির্মিত এই মসজিদটি ছিল সেই সময়ের সর্বপ্রথম ইটের নির্মিত স্থাপত্যশিল্প। পরবর্তীতে চন্দ্রদ্বীপে ঘূর্ণিঝড় ও মগ-পর্তুগিজ জলদস্যুদের আক্রমণে মসজিদ ও আশেপাশের জায়গা সুন্দরবনের গভীর অরণ্যের সাথে মিশে দীর্ঘদিন জনবসতিহীন হয়ে পড়েছিল। ১৮৬০-এর দশকে, ব্রিটিশ সরকার সুন্দরবন চাষ করার পরিকল্পনা শুরু করে এবং মসজিদটি পুনঃআবিষ্কার করে। সেসময়কার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হেনরি বেভারিজ মসজিদটি পরিদর্শন করেন। ১৯০৪ সালে বাকেরগঞ্জ (বরিশালের প্রাচীন নাম) জেলার পূর্ববর্তী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিকোলাস বিটসন-বেলের অধীনে মসজিদের অভ্যন্তরীণ অংশটি সংস্কার করা হয়। এলাকাটি তখন স্থানীয়দের দ্বারা মসজিদবাড়ি বা মসজিদবাড়িয়া নামে পরিচিত হয়। পরে লোকের মুখে মুখে এটি মজিদবাড়িয়ায় পরিণত হয়। যদিও কেউ কেউ দাবি করেন যে এটি মজিদ নামে স্থানীয় চেয়ারম্যানের নামে নামকরণ করা হয়েছিল।
এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, এই মসজিদে এখনও প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় হয়। রমজান মাস জুড়ে মুসল্লিরা তারাবির নামাজ আদায় করেন। এখানে দুই ঈদে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও মসজিদ ও মসজিদ সংলগ্ন চত্বরে প্রতি বছর বার্ষিক ওয়াজ মহফিল অনুষ্ঠিত হয়। ওয়াজ মাহফিলে দূরদূরান্ত থেকে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমানের উপস্থিতিতে জমজমাট হয়ে ওঠে মসজিদ প্রাঙ্গণ।
প্রাচীন এই মসজিদটি দেখার জন্য প্রায়ই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসেন। এটি এই অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্রও। কিন্তু সংস্কারের অভাবে মসজিদটি তার সৌন্দর্য হারাতে বসেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় পর্যটকদের যাতায়াতেও অনেক অসুবিধা হয়। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে স্থানীয় বাসিন্দারা মসজিদের জরুরি সংস্কারের পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে নজর দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
স্থানীয়দের দাবি, ঐতিহ্যবাহী মসজিদটির মূল নকশা ঠিক রেখে সংস্কারের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা জরুরি। দূরদূরান্ত থেকে যারা এখানে বেড়াতে আসেন তাদের জন্য একটি বিশ্রামাগার প্রয়োজন। এছাড়া মসজিদের পাশে যে দিঘীটি রয়েছে সেখানে কোন ঘাট না থাকায় ভোগান্তি পোহাতে হয় ভ্রমণ পিপাসুদের। এরকম আরও নানান সমস্যা রয়েছে।
তারা দ্রুত সংস্কারের মাধ্যমে প্রাচীনতম মুসলিম স্থাপত্যের নিদর্শনকে রক্ষা করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের জরুরী পদক্ষেপ কামনা করেন।
পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন বাসসকে বলেন, ঐতিহ্যবাহী মজিদবাড়িয়া শাহী মসজিদের সংস্কারের ব্যাপারে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে অবহিত করা হয়েছে। অধিদপ্তরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।