বাসস
  ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৫:০৪
আপডেট : ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৫:১৮

কোমর তাঁত: বৈসাবি উপলক্ষে কোমরের কৌশলে বোনা হচ্ছে বাহারি সুতার পোশাক

পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসাবিকে সামনে রেখে প্রতিটি পল্লীতেই চলছে কোমর তাঁতের সাহায্যে কাপড় বুননের কাজ। ছবি : বাসস

খাগড়াছড়ি, ৭ এপ্রিল ২০২৫ (বাসস) : পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসাবিকে সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন পাহাড়ের নারীরা। পাহাড়ের প্রতিটি পল্লীতেই চলছে কোমর তাঁতের সাহায্যে কাপড় বুননের কাজ। বৈসাবি উৎসব উপলক্ষে পিনন ও থামি তৈরি করে স্থানীয় বাজারের বিভিন্ন দোকানে সরবরাহ করে বাড়তি আয়ের আশা করছেন নারীরা। 

স্থানীয় জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন চাহিদার পাশাপাশি পর্যটকদের কাছেও পাহাড়িদের তৈরি এসব পোষাক জনপ্রিয়। কোমর তাঁতের মাধ্যমে কাপড় বুনে প্রতি মাসে এক জন নারী পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেন। এতে তাদের বাড়তি যে আয় হয় সেটি দিয়ে চলে ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার খরচ। তবে বৈসাবি উৎসব আসলে তাদের তৈরি পোশাকের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

সরেজমিনে খাগড়াছড়ির বিভিন্ন পল্লিতে দেখা যায়, প্রতিটি পল্লিতে নারীরা কঠোর পরিশ্রমে তৈরি করছেন নতুন নতুন বাহারি রঙের পোশাক। গৃহস্থালি কাজ শেষ করে বাড়তি আয়ের আশায় কোমর তাঁতের মাধ্যমে পিনন, খাদি (রিনাই-রিসা) তৈরীতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। 

পাহাড়ি নারীরা অন্যদের তুলনায় একটু বেশিই পরিশ্রমী। তাদের জীবন যুদ্ধে কেউ হার মানাতে পারেন না। জুম চাষ ছাড়াও পাহাড়ি নারীরা পরিবারের বাড়তি উপার্জনের জন্য বানিয়ে থাকেন কোমর তাঁত এর রিনাই-রিসা। 

‘কোমর তাঁত’ হলো পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও জীবিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি একটি ঐতিহ্যবাহী হস্তচালিত তাঁত। নারীরা নিজের কোমরের সাথে বাঁশ ও কাঠের কাঠি ব্যবহার করে কাপড় বুনেন বলে একে ‘কোমর তাঁত’ বলা হয়। 

আধুনিক প্রযুক্তির বদলে এখনও কাপড় বোনার জন্য পাহাড়ি নারীরা বাঁশ ও কাঠের নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। একসময় পাহাড়ি এলাকায় উৎপাদিত তুলা থেকে চরকার সাহায্যে সুতা তৈরি করে পিনন ও থামির কাজ করা হতো। কিন্তু এখন পাহাড়ে তুলার উৎপাদন কমে যাওয়ায় এবং তুলা থেকে সনাতন পদ্ধতিতে সুতা তৈরি সময় সাপেক্ষ হওয়ায় বাজার থেকে সুতা কিনেই কাপড় বুনতে হচ্ছে। পাহাড়ি নারীরা গৃহস্থালির কাজ আর জুম চাষের ফাঁকে কোমর তাঁতে পিনন ও থামি তৈরি করে স্থানীয় বাজারের বিভিন্ন দোকানে সরবরাহ করেন। তবে এই থামির চাহিদা পুরো বছর থাকলেও বৈসাবি আসলে চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। পাহাড়ি ঐতিহ্য ধরে রাখতে সবাই বৈসুতে এই পোশাক পড়েন। তাই সবাই রিনাই-রিসা কিনতে আসেন। এ কারণে সারা বছরের তুলনায় বৈসাবিতে এর দামও বেশি থাকে।

রিনাই ও রিসা বুননকারী সুচরিতা ত্রিপুরা ও রুচিতা ত্রিপুরা জানান, সংসারের বাড়তি খরচ যোগাতে তারা সারা বছরই কোমর তাঁতে পিনন খাদি তৈরি করে থাকেন।  বৈসাবি উপলক্ষে এর চাহিদা বেশি থাকায় গত দুই মাস ধরে একটু বেশি পরিশ্রম করতে হচ্ছে। 

রুচিতা ত্রিপুরা বলেন, এ সময় বাড়তি যা টাকা পাই তাই দিয়ে আমরা পরিবার পরিজন নিয়ে আনন্দের সাথে বৈসাবি উদ্যাপন করি ।

নারী উদ্যোক্তা চামেলী ত্রিপুরা জানান, বৈসাবি ছাড়াও বিয়ে ও বিভিন্ন উৎসব-পার্বনে রিনাই-রিসা’র চাহিদা বেড়ে যায়। আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় নিজেরা টাকা দিয়ে সুতা কিনতে পারেননা নারীরা। অন্যের কাছ থেকে সুতা এনে কাপড় বানিয়ে নিদিষ্ট একটি পারিশ্রমিক পান মাত্র। তাদের জন্য কোনো ব্যাংক ঋণেরও ব্যবস্থা নেই। 

তিনি বলেন, সরকারি সহযোগিতা পেলে রিনাই-রিসা প্রস্তুতকারী পাহাড়ি নারীরা এই শিল্পকে অনেকদূর এগিয়ে নিতে পারবেন। তাদের তৈরি পোশাক পাহাড়ের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ব বাজারে চাহিদা তৈরি করতে  সক্ষম হবে। 

খাগড়াছড়ি মহিলা অধিদপ্তর এর উপ-পরিচালক সুস্মিতা খীসা পাহাড়ি নারীদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে বলেন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য সুযোগ আছে। তারা দলবদ্ধ হয়ে আসলে তাদের ঋণ সুবিধা দেওয়া হবে।   এছাড়া তাদের জন্য মহিলা অধিদপ্তরে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও আছে। 

তিনি জানান, ডিজাইন ভেদে এক একটি রিনাই-রিসা ৩ শত টাকা থেকে ১০ হাজার টাকার বেশি দামে  বিক্রি করা হয়।