শিরোনাম
কাশেম মাহমুদ
ঢাকা, ১২ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস): চৈত্র সংক্রান্তি। বাংলা বছরের শেষ মাস চৈত্রের শেষদিন। এ দিনে শুরু হয় হিসাবের ‘হালখাতা’ হালনাগাদের কাজ। শুরু নতুন বছরের হিসাব নিকাশের পালা।
চৈত্র সংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ বাঙালীর শতবছরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অমোচনীয় লালিত ঐতিহ্য ও ইতিহাস।
প্রতিবছরের মতো আবারো চৈত্র সংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ দরজায় কড়া নাড়ছে। কাল রোববার ১৩ এপ্রিল ৩০ চৈত্র বিদায়ী বাংলা সনের শেষদিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তি।
পরদিন সোমবার ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ। বাংলা বছরের প্রথম দিন।
যারা ব্যবসায়ী বিশেষ করে তাদের কাছে এ দুটি দিনের তাৎপর্য অপরিসীম। তারা চৈত্র সংক্রান্তিতে বিদায়ী বছরের হিসেবের লেনদেনের ইতি টানে। কেউ টানে ইজা। অর্থাৎ হিসাবের ‘হালনাগাদ’ থেকে ‘হালখাতা’। শত বছর ধরে ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবসায়ীদের কাছে ‘হালখাতা’ একটি পবিত্র খতিয়ান। সারা বছরের লাভ লোকসান, দেনা পাওনা, জমা খরচের খতিয়ান। এখান থেকে শুরু নতুন বছরের। ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসাকে পবিত্র মনে করে সযত্নে প্রার্থনায় লালন করে। বাংলা নববর্ষের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই ‘হালখাতা’ অনুষ্ঠান। বাঙালির ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এই ‘হালখাতা। সমাজের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব পালনে আড়ম্বরতায় ভাটা পড়লেও তা আপন ঐতিহ্যে এখনো টিকে আছে স্বমহিমায়। কেননা ‘হালখাতা’ যে বাঙালি বনেদি ব্যবসায়ীদের শেকড়ের সঙ্গে গাঁথা।
সাধারণভাবে ‘হালখাতা’ হলো নববর্ষে নতুন হিসাব লেখার খাতা। নতুন খাতাটি সাধারণত লালসালুতে মোড়ানো থাকে। হালখাতা হলো বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রচলিত একটি ঐতিহ্যবাহী প্রথা। এ দিনটিতে ব্যবসায়ীরা তাঁদের পুরোনো হিসাব হালনাগাদ করে নতুন হিসাব শুরু করেন। এ উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁদের নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানান। হালখাতা মূলত একটি বাণিজ্যিক প্রথা হলেও কালের পরিক্রমায় এটি একটি সামাজিক প্রথায় পরিণত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ দিনটিতে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্ককে আরও মজবুত করার একটি সুযোগ তৈরি হয়। চৈত্র মাসের শেষদিনে হিসাব নিকাশ শেষ করে প্রতিটি পরিবারে ভালো খাবারের আয়োজন করা হয়। পরিবারের সদস্যরা নতুন জামা পরে আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে।
শতবছরের বাঙালী সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ ‘হালখাতা’ হলেও ইদানীং সেই তাতে বাধ সেধেছে প্রযুক্তি। আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির এই সময়ে বিভিন্ন অ্যাপস ও অনলাইন শপিংয়ের কারণে হালখাতার সেই আগেকার দিনের জৌলুস কমে এসেছে। ব্যাংক, বীমা কর্পোরেট অফিসগুলো বড় বড় বালাম খাতার পরিবর্তে কম্পিউটার নির্ভর হয়ে গেছে।
এতকিছুর পরও বাঙালী সংস্কৃতিতে নববর্ষের প্রথম দিনে হালখাতা চালুর প্রচলন শেষ হয়ে যায়নি। রাজধানী ঢাকার তাঁতীবাজার, লক্ষ্মীবাজার ও শাঁখারি বাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা এই ঐতিহ্য এখনো ধরে রাখতে স্বল্প পরিসরে ‘হালখাতা’ করে থাকেন। পুরান ঢাকার বাংলাবাজার ও ইসলামপুরের ব্যবসায়ীরা জানান, তারা উৎসবের আনন্দে হালখাতা উদযাপন করেন। বাংলা নববর্ষের প্রথমদিন থেকে লালসালু মোড়ানো খাতায় হিসাব শুরু করেন ব্যবসায়ীরা।
ইসলামপুরের ব্যবসায়ী মনিরুজ্জামান বাসসকে বলেন, একসময় মানুষের হাতে নগদ অর্থ কম ছিল। তখন মানুষ বাকিতে প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতেন, আর সেই বাকির টাকা তুলতে হালখাতা হতো। আমরা এখনো আমাদের সারাবছরের ক্রেতাদের সাথে হালখাতা মেনটেইন করে ব্যবসা করে আসছি। তবে পুরোনো এই ঐতিহ্যে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এখন মানুষের হাতে টাকা না থাকলেও বিকল্প ব্যাংক কার্ড থাকে, ফোন ব্যাংকিং হয়, ফলে এখন আর আগের মতো বাকিও পড়ে না। আর পড়লেও বিকাশ-নগদ কিংবা কার্ডে সেই বিল পরিশোধ হয়। এজন্য দোকানের ক্রেতাদের আসতে হয় না। ফলে লালসালুতে বাধাঁই করা হালখাতার উপযোগিতা কমে আসছে।
চট্টগ্রামের বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র হিসাবে পরিচিত খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী ইদ্রিচ মিয়া বলেন, আমাদের পূর্ব-পুরুষদের ঐতিহ্য এই ব্যবসা ও হালখাতা। সেই ধারাবাহিকতা রক্ষায় এখনো আমরা হালখাতা করে আসছি।
তিনি বলেন, আমাদের নতুন প্রজন্ম হালখাতা কী তা জানে না। তারা পহেলা বৈশাখের আনন্দে-উৎসবে মেতে ওঠে। মিছিল সমাবেশ করে। দিনব্যাপী মেলায় যায়। আল্পনায় ফুটিয়ে তোলে বাঙ্গালী সংস্কৃতি। যদি জিজ্ঞেস করা হয় হালখাতা কী। এটি কি বিশেষ ধরনের কোনো খাতা? কী করা হয় এ খাতায়? কবে থেকে প্রচলন হলো এই ঐতিহ্যবাহী প্রথার? জবাব দিতে পারে না। তারা মোবাইল, ইন্টারনেট, কম্পিউটার নির্ভর হয়ে পড়েছে। পহেলা বৈশাখে উৎসব করে। কিন্তু শেকড়ের সন্ধান করে না।
‘হাল’ শব্দটি ফারসি ভাষা থেকে এসেছে। ফারসি শব্দ ‘হাল’ এর অর্থ ‘নতুন’। ইতিহাসের দলিল পর্যালোচনা করে জানা যায়, ১৫৫৬ সালে মোগল সম্রাট আকবর সিংহাসনে আরোহণের পর প্রদেশের খাজনা আদায়ের দিন-তারিখের একটি অভিন্ন সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করেন। চান্দ্র বছরের গণনানুযায়ী, সৌর বছরের সঙ্গে দিনের পার্থক্য অনেক। ফলে চান্দ্র বছরের রীতি অনুযায়ী বছরের রাজস্ব আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট দিন ধার্য করা সম্ভব ছিল না। সে সময়ে ফসলে রাজস্ব আদায় করা হতো। কোনো কোনো বছর ফসল তোলার আগেই খাজনা দেওয়ার দিনটি এসে যেত। এতে করে প্রজারা খাজনা দিতে অসুবিধার সম্মুখীন হতো। সম্রাট আকবর প্রজাসাধারণের এই অসুবিধা দূর করার জন্য নতুন সন প্রবর্তনের চিন্তাভাবনা শুরু করেন। ১৫৫৬ সালে সম্রাট আকবরের শাসন ক্ষমতা গ্রহণের সময় হিজরি সন ছিল ৯৬৩। আর এ বছর থেকেই তিনি হিজরি সনকেই সৌর সনে পরিবর্তিত করে বাংলা সন চালু করেন।
প্রথমে এই সালের নাম রাখা হয়েছিল ফসলি সন। পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা নববর্ষ হিসেবে পরিচিতি পায়। এরপর চৈত্র মাসের শেষদিনে (চৈত্র সংক্রান্তি) জমিদারি সেরেস্তারা প্রজাদের কাছ থেকে কৃষি ও রাজস্ব কর বা খাজনা আদায় করতেন। এ সময় প্রতি চৈত্র মাসের শেষদিনের মধ্যে সব খাজনা, মাশুল বা কর পরিশোধ করা হতো। এর পরেরদিন পয়লা বৈশাখে ভূমির মালিকেরা নিজেদের অঞ্চলের প্রজা বা অধিবাসীদের মিষ্টি, মিষ্টান্ন, পান-সুপারি প্রভৃতি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। এটিই কালের পরিক্রমায় ‘হালখাতা’ হিসেবে পরিচিতি পায়। তখন বাঙালী মুসলমানরা খাতার প্রথম পাতায় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বা ‘এলাহি ভরসা’ লিখতেন।
ডিজিটাল যুগে ভাটা পড়েছে ঐতিহ্যের হালখাতায়। চারপাশে প্রযুক্তির ছোঁয়া, কম্পিউটার, ল্যাপটপ আর অ্যাপসের দুনিয়ায় হাতে লেখা খাতার প্রচলন প্রায় উঠে যেতে বসেছে। ফলে এখন আর বাংলা সনের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীদের নতুন হালখাতা খুলতে খুব একটা দেখা যায় না। তবে ঐতিহ্য রক্ষায় এখনো রাজধানীর অনেক ব্যবসায়ী রীতি ধরে রাখতে হালখাতা উৎসব করে থাকেন। এই হালখাতার উৎসব হয় মূলত, বৈশাখ মাসের প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনে। এদিন ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করিয়ে পুরোনো বছরের লেনদেন চুকিয়ে, নতুন বছরে খোলা হয় হিসাবের নতুন খাতা। শুরু হয় হালখাতা’র হালনাগাদ।