বাসস
  ১২ এপ্রিল ২০২৫, ১৩:০৬

নদীতে ফুল উৎসর্গে মধ্য দিয়ে খাগড়াছড়িতে শুরু হয়েছে প্রাণের উৎসব ‘বৈসাবি’

শনিবার জেলায় চাকমা সম্প্রদায়ের ফুল বিজু, বৈসাবি শুরু হয়েছে। ছবি : বাসস

খাগড়াছড়ি,১২ এপ্রিল,২০২৫ (বাসস): নদীতে মা গঙ্গাদেবীর  উদ্দেশ্যে ফুল দিয়ে পূজা করার মধ্যে দিয়ে জেলায় চাকমা সম্প্রদায়ের ফুল বিজু, বৈসাবি শুরু হয়েছে।

আজ সকালে  চেঙ্গী নদীতে ফুল নিবেদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে চাকমাদের বিজুর মূল আনুষ্ঠাকিতা। এতে অংশ নিয়েছে হাজারো মানুষ। পাহাড়ের উৎসব সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আরো সুদৃঢ় হবে বলে মনে করছে অনেকেই। উৎসব ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার করেছে পুলিশ। 

ফুল বিঝুকে কেন্দ্র করে আজ সকাল থেকে চেঙ্গী নদীর নির্বারিত স্থানে ফুল ভাসাতে নদীর তীরে তরুন-তরুনীদের স্রোত নামে। উৎসব উপভোগ করতে সকালে চেঙ্গী নদীর পারে উপস্থিত হন খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ মো. আমান হাসান, জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ওয়াদুদ ভূইয়া,জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম,পুলিশ সুপার  মো. আরেফিন জুয়েলসহ সামরিক,রাজনৈতিক ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা। 

অপরদিকে তখনও ভালো করে আলো ফুটেনি। ফুটে উঠেনি সূর্যের পরিপূর্ণ রুপ। এরি মধ্যে ঐহিত্যবাহী পোশাকে সেজে নদীর পাড়ে আসতে শুরু করে তরুণ-তরুণীরা।

ছোটরা এসেছে বাবা-মার হাত ধরে। বছরের গুরুত্বপূর্ণ ও আনন্দদায়ক দিন বলে কথা। বৈসাবির প্রথম দিনে চেঙ্গী নদীর পাড়ে ফুল দিয়ে পুজা  ও স্নান করে পবিত্র হওয়ার মাধ্যমেই  শুরু হয় বৈসাবির আনুষ্ঠানিকতা। চাকমা ও ত্রিপুরারা উৎসবের প্রথম দিনে বন পাহাড় থেকে সংগৃহিত ফুল দিয়ে ঘর সাজায়।সবার মঙ্গল কামনায় কলা পাতা করে ভক্তি শ্রদ্ধাভরে গঙ্গাদেবীর উদ্দ্যেশে ফুল উৎসর্গ করে  পুরাতন বছরের গ্লানী ভুলে নতুন বছরের শুভ কামনা করে। প্রত্যাশা করা হয় পাহাড়ে হানাহানি ভুলে সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে আসবে শান্তি ও সম্প্রীতি। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে গোটা পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিনত হয় সব সম্প্রদায়ের মানুষের মিলন মেলায়। এদিকে এই উৎসব দেখতে খাগড়াছড়িতে বেড়েছে পর্যটকের সংখ্যা। বলা যায় উৎসবে রঙ্গীন পার্বত্য চট্টগ্রাম।এই ধরণের উদ্যোগ পাহাড়ে সম্প্রীতি ও ঐক্যের বন্ধন সুদৃঢ় করবে বলে মন্তব্য করেছেন,জেলা প্রশাসক। 

জেলা পুলিশ সুপার  জানান  বৈসাবি উৎসব ও বাংলা নববর্ষ ঘিরে  পর্যটকে মুখর হবে খাগড়াছড়ি। তাই উৎসব ঘিরে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহন করেছে জেলা পুলিশ।

আজ শনিবার চাকমা সম্প্রদায় ফুল বিজু পালন করছে। আগামীকাল রোববার মূল বিঝু আর পরের দিন সোমবার পহেলা বৈশাখ বা গজ্জাপয্যা পালন করবে। এ সময় ঘরে ঘরে চলবে অতিথি আপ্যায়ন। একই সাথে রোববার (১৩ এপ্রিল) ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের হারিবৈসু,বিযুমা,বিচিকাতাল,ফুল বিজু,মূলবিজু ও বিচিকাতাল নামে নিজস্ব বৈশিষ্টতায়।

অপর দিকে সোমবার (১৪ এপ্রিল) খাগড়াছড়িতে মারমা সম্প্রদায় সাংগ্রাইং উৎসবে ঐতিহ্যবাহী জলকেলি বা পানি খেলা ও  জেলা প্রশাসনে উদ্যোগে হবে বর্ষবরণের র‌্যালী।

এ উৎসবে আনন্দের আমেজ ছড়ায়। চেঙ্গী নদীতে চাকমা সম্প্রদায়ের সাথে ফুল উৎসর্গদের সামিল হয়েছেন অন্য সম্প্রদায়ের মানুষও। বৈসাবি উৎসব দেখতে এসেছে অনেক পর্যটকও।

জানা যায়,ফুল বিঝু,হারি বৈসুর দিন ভোর থেকে বাড়ির পাশের নদী ও খালে গিয়ে প্রার্থনারত হয়ে পুরাতন বছরকে বিদায় জানায় ত্রিপুরা ও  চাকমা সম্প্রদায়ের বিভিন্ন বয়সী নর-নারী। তবে এখন ফুল বিজু শুধুমাত্র চাকমা সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ নেই। মারমা ও স্থানীয় বাঙালীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা এসে অংশ নিচ্ছেন ফুলবিজু ও হারি বৈসুতে। ফুল নিবেদন শেষে তরুণ তরুণীরা মেতে ওঠেন আনন্দ উৎসবে। নদীতে স্নান শেষে বাড়ি গিয়ে বায়োজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করে ছোটরা।

ঘরবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সাজসজ্জা শেষে প্রস্তুতি চলে অতিথি অ্যাপায়নের। ত্রিপুরা ও মারমা সম্প্রদায়ের চলছে বিভিন্ন গ্রামীণ খেলাধুলাও।

নদীতে ফুল দিতে আসা বিজয়া খীসা বলেন, পুরাতন বছরের দুঃখ গ্লানি ও পাপাচার থেকে মুক্তির জন্য দেবতার উদ্দেশে ফুল ভাসিয়ে পুরাতন বছরকে বিদায় জানালে নতুন বছর সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধির বার্তা দেবে। 

উর্নিষা চাকমা বলেন,ফুল বিঝুর মধ্যদিয়ে আমরা পুরাতন বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নিচ্ছি। ফুল বিঝুর মধ্যদিয়ে আমাদের বৈসাবি উৎসবের সূচনা হয়েছে।

চট্টগ্রাম থেকে আসা মনিকা চন্দ বলেন,আমি পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী বৈসাবি উপলক্ষ্যে ত্রিপুরা ও চাকমাদের নদীতে ফুল নিবেদনের দৃশ্য স্বচক্ষে দেখার জন্য এসেছি। এমন কালারফুল অনুষ্ঠান দেখে খুবই ভালো লাগছে।

ঢাকা থেকে পর্যটক সীমা দাশ বলেন,আমি এতদূর থেকে খাগড়াছড়িতে আসছি পাহাড়ীরা নদীতে ফুল নিবেদনের এমন মনোরম দৃশ্য দেখার জন্য। আমি এমন অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পেরে সার্থক হলাম।আমি সত্যিই খুবই আনন্দিত।

স্থানীয় চাকমা তরুণী মমতা চাকমা বলেন, নদীতে ফুল নিবেদনের মধ্যদিয়ে আমরা স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করি যে,অতীতের সকল দুঃখ,কষ্ট মুছে, নতুন বছরে নতুনভাবে যেন সম্পূর্ণ সুস্থ্যভাবে জীবন যাপন করতে পারি।

এ ব্যাপারে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) রুমানা আক্তার বলেন,পাহাড়ের প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসাবিতে চাকমাদের ফুল বিঝু উপলক্ষে নদীতে ফুল দিয়ে সারিবদ্ধভাবে প্রণাম জানাচ্ছে। এমন দৃশ্য পাহাড়ের সৌন্দর্যকে আরও দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিশিষ্ট শিক্ষাবীদ প্রদীপ্ত খীসা বলেন,চাকমা সম্প্রদায় প্রতি বছর নদীতে ফুল দিয়ে প্রণাম জানাই  অতীতের দুঃখ,গ্লানি দূর হওয়ার আশায়। নদীতে ফুল দিয়ে প্রণামের মধ্যদিয়ে আমাদের বৈসাবি উৎসব শুরু হয়েছে।