বাসস
  ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৬:৫৮

ঘোড়াঘাটে জমি কেটে মাটি বিক্রি করায় আশঙ্কাজনক হারে কমছে আবাদি জমি  

দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে জমি কেটে মাটি বিক্রি করায় আশঙ্কাজনক হারে কমছে আবাদি জমি। ছবি: বাসস  

প্রতিবেদক: রোস্তম আলী মণ্ডল

দিনাজপুর, ১৮ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস): জেলার কয়েকটি উপজেলায় দিন-রাত অবৈধভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন ও আবাদি জমির মাটি কেটে ইট ভাটা মালিকদের কাছে বিক্রি করায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে বিপুল পরিমাণ ফসলি জমি। আবাদি জমিতে গভীর খনন করে মাটি কাটায় কমছে জমির উর্বরতা।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার করতোয়া নদীতে অবৈধ ভাবে চলছে বালু উত্তোলন। অবাধে বালু তোলায় হুমকির মুখে করতোয়া নদীর দুই পারের জনবসতি। গ্রামগুলো নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার হুমকিতে রয়েছে। 

স্থানীয়দের অভিযোগ, এলাকার প্রভাবশালী লোকজন প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে করতোয়া নদী থেকে ড্রেজিং মেশিনের সাহায্যে দিন-রাত বিরতিহীনভাবে বালু উত্তোলন করছে। সেই বালু সবার চোখের ওপর দিয়ে ট্রাক্টরে করে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাচ্ছে। নদী থেকে বালু উত্তোলনের কারণে নদীর মধ্যে একাধিক স্থানে গভীর কূপ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে নদীতে গোসল করতে গিয়ে শিশুসহ বয়স্ক ব্যক্তিরা এসব নদীর কূপে পড়ে প্রাণ হারানোর ঘটনা ঘটছে। কিন্তু আইনি ব্যবস্থা সঠিক ভাবে প্রয়োগ না হওয়ায় বালু উত্তোলনকারী ভূমিদস্যুরা তাদের এসব অবৈধ কার্যক্রম চালিয়েই যাচ্ছে। 

সচেতন মহলের অভিযোগ, এসব অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। 

অনিয়ন্ত্রিত ভাবে এসব বালু উত্তোলনের কারণে নদীর দুই ধারে বিপুল পরিমাণ বসতবাড়ি, ফসলি জমি, সড়ক ও বাঁধসহ বিভিন্ন স্থাপনা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করলেও বন্ধ হয়নি বালু উত্তোলন।

সরেজমিনে দেখা যায়, জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলার শালিকাদহ, কৃষ্ণরামপুর, নারায়ণপুর, মারুপাড়া, ভেলামারি, সাতপাড়া, কুলানন্দপুর, বৈদর, ভর্ণাপাড়া, গুয়াগাছি, টঙ্গী, ঋষিঘাট, রামনগর, কুমরিয়া, শ্যামপুর, লালমাটিসহ অন্তত ২০ পয়েন্টে নির্বিচারে চলছে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন। এসব এলাকায় প্রতিদিন ড্রেজার মেশিন দিয়ে প্রকাশ্যে তোলা হচ্ছে বালু। দিনরাত ট্রাক্টর যোগে বিভিন্ন স্থানে বালু নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মহা উৎসবে বালু উত্তোলন ও স্থানান্তরের কাজ অব্যাহত রয়েছে। 

ঘোড়াঘাট উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. মকবুল হোসেন (৭৫) বলেন, এই মুহূর্তে এসব অবৈধ বালু উত্তোলনকারী ভূমি দস্যুদের অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করা না হলে, বিপুল পরিমাণ আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, বালু উত্তোলনের ফলে আগামী বর্ষা মৌসুমে এলাকার জনসাধারণকে ভয়ানক অবস্থায় পড়তে হবে। তখন দুর্ভোগ দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।  

ঘোড়াঘাট উপজেলা জামায়াতে ইসলামের আমির ও উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস-চেয়ারম্যান মো. আলমগীর হোসেন (৬৫) বাসসকে বলেন, অপরিকল্পিতভাবে দীর্ঘদিন ধরে বালু উত্তোলন করছে এক শ্রেণির অসাধু প্রভাবশালী মহল। যার ফলে করতোয়া নদীর ভাঙন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফসলি জমি, ঘরবাড়ি, বাঁধসহ বিভিন্ন স্থাপনা। কেউ বাধা দিলে আসে হুমকি-ধামকি। তবে একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে এই বিষয়টি উপজেলা প্রশাসন এবং জেলা প্রশাসনকে একাধিকবার অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। 

এলাকাবাসী জানায়, বছরের পর বছর ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। বালু উত্তোলন ও বিক্রি দুটোর সাথে জড়িত স্থানীয় প্রভাবশালী কিছু নামধারী নেতা। তাদের ভয়ে কেউ মুখ খোলেনা। 

বালু ব্যবসায়ী ঘোড়াঘাট উপজেলার সিংড়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাফিনুর ইসলাম কাফি মুঠোফোনে বাসসকে বলেন, ‘আমি প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ গাড়ি করে বালু উত্তোলন করি। কয়েক দিন ধরে বালু উত্তোলনের পরিমাণ বাড়িয়েছি। সামনে বর্ষা মৌসুম শুরু হয়ে যাবে। তাই কিছু বালু মজুদ করে রাখবো। যা বর্ষা মৌসুমে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করতে পারব।’  

ঘোড়াঘাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রফিকুজ্জামান বলেন, ঘোড়াঘাট উপজেলার ৪টি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভায় প্রায় ১২টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ৬টি ইট ভাটার ইট পোড়ানোর লাইসেন্স রয়েছে। অপর ৬ টি ইটভাটা লাইসেন্সবিহীন অবস্থায় চালু রয়েছে। এসব ইটভাটায় অব্যাহতভাবে আবাদি জমি গভীর ভাবে খনন করে মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জমির মালিকরা টাকার লোভে ইটভাটা মালিকদের কাছে মাটি বিক্রি করে ফসলি জমির ক্ষতি করছেন। 

তিনি জানান, গত ১০ বছরে শুধু এই একটি উপজেলায় কয়েক শত হেক্টর জমির মাটি বিক্রি করার কারণে তিন ফসলি জমির ফসল উৎপাদন কার্যক্রম বিনষ্ট হয়ে গেছে। এভাবে প্রতি বছর উর্বর ফসলি জমির মাটি গভীর ভাবে কেটে নিয়ে যাওয়ার কারণে ফসলি জমির সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। 

দিনাজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. জাফর ইকবাল জানান, তিনি গত দুই মাস হলো এই জেলার কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেছেন। এর মধ্যে তিনি বেশ কয়েকটি উপজেলা পরিদর্শনে গিয়ে স্বচক্ষে দেখেছেন।  

তিনি বলেন, ইটভাটা মালিকরা টাকার প্রলোভন দিয়ে জমির মালিকদের কাছ থেকে ফসলি জমির মাটি গভীরভাবে খনন করে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে খনন করা জমিতে আর ফসল চাষের কোনো উপায় থাকে না। এভাবে মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ার ফলে ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। 

তিনি বিষয়টি জেলা প্রশাসককে অবগত করেছেন। আগামী কৃষি বিষয়ক সভায় বিষয়টি উপস্থাপন করবেন বলে তিনি জানান।         

ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রফিকুল ইসলাম বলেন, অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে তাদের অভিযান অব্যাহত আছে। এর মধ্যে কয়েক জন বালু উত্তোলনকারীকে জরিমানা করা হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন। 

তিনি বলেন, টাকার লোভে আবাদি জমির মাটি বিক্রি করায় আবাদি জমির সংখ্যা কমে যাওয়ার বিষয়টি আশংকাজনক। এ বিষয়টি তিনি জেলা প্রশাসনের বৈঠকে উপস্থাপন করবেন বলে জানান। 

তিনি আরো বলেন, ‘অভিযানের খবর বালু উত্তোলনকারীরা আগেই পেয়ে যান। যার কারণে বেশির ভাগ অভিযান ব্যর্থ হয়ে যায়। তারপরও এই অভিযান চলতে থাকবে।’