শিরোনাম
নেত্রকোনা, ২০ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস): জেলার স্থানীয় মানুষের চাহিদা মিটিয়ে চ্যাপা শুঁটকি যাচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে। চ্যাপা শুঁটকি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন এ জেলার বেশ কিছু ব্যবসায়ী।
সারাদেশে সিদল নামে পরিচিত থাকলেও জেলাবাসীর কাছে চ্যাপা শুঁটকি মূলত হিদল নামে পরিচিত। এ অঞ্চলে হিদলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে,বিশেষ করে বর্ষাকালে যখন মাঠ, ঘাট, নদীনালা পানিতে টইটম্বুর তখনি গ্রাম-শহরের বেশিরভাগ রান্নাঘর থেকে ভেসে আসে হিদল ভর্তার ঘ্রাণ। লেবুর রস চিপে হিদল ভর্তা দিয়ে ভাত খাওয়া যেন অমৃত এক খাবার।
হাওরাঞ্চল হিসেবে পরিচিত জেলার প্রতিটি উপজেলায় কম-বেশি চ্যাপা শুঁটকি উৎপাদন করা হয়ে থাকে। তবে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন করা হয় জেলার বারহাট্টা উপজেলার চরসিংধা ও মোহনগঞ্জ উপজেলায় শুঁটকি মহলে। জেলার সদর উপজেলার পঞ্চাননপুর গ্রামেও বেশ কয়েকটি পরিবার এ চ্যাপা শুঁটকি উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ত।
এ চ্যাপা শুঁটকি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি করা হয় এবং সারাদশেই রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা এ জেলার প্রবাসীরাও দেশ থেকে চলে যাওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে যান এ লোভনীয় চ্যাপা শুঁটকি।
পঞ্চাননপুর গ্রামের চ্যাপা শুঁটকি কারিগর শ্রীকান্ত চন্দ্র বর্মণ জানান," বংশ পরম্পরায় তারা এ কাজের সাথে সম্পৃক্ত, প্রায় একশত বছরেরও বেশি সময় নিয়ে তাদের পরিবার এ কাজ করে যাচ্ছেন। তারা চ্যাপা শুঁটকির একটি বড় অংশ সনাতন পদ্ধতিতে মাছ প্রক্রিয়াকরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। চ্যাপা শুঁটকির কাঁচামাল তথা পুঁটিমাছ বাছাইকালে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। নষ্ট, পঁচা বা আংশিক পঁচা মাছ ব্যবহার করা হয় না। সদ্য আহরণ করা মাছকে সংগ্রহ করে যথাযথভাবে পরিচর্যা করে শুকানো হয়।
পরবর্তীতে বিভিন্ন বাজার থেকে শুকনো মাছ ক্রয় করে গোডাউনে নিয়ে আসেন। এবং কিছুদিন গোডাউনে রাখার পর শুটকি বাছাই করা হয় এবং বাছাইকৃত মাছ পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অবস্থায় শুঁটকিকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। "
তিনি আরো জানান, এজন্য প্রথমে মাটির মটকা তেল দিয়ে ভিজিয়ে ভালোভাবে প্রস্তুত করতে হয়। পুঁটি মাছ থেকে উৎপাদিত তেলে অনেক ময়লা ও বাড়তি আর্দ্রতা থাকে তাই প্রাপ্ত তেল ভালোভাবে ছেঁকে নিতে হয়। ছেঁকে নেয়া তেল পুনরায় চুলায় ভালোভাবে ফুটিয়ে বা গরম করে ব্যবহার করতে হয়। এতে তেলে থাকা বাড়তি আর্দ্রতা চলে যায় এবং জীবাণুও মুক্ত হয়। তেলে ভেজানো মাটির মটকা মাটিতে পুঁতে হয়। তারপর মটকার ভিতরে ভালোভাবে পরিষ্কার হাত দিয়ে চেপে চেপে ভরতে হয় বাছাইকৃত শুঁটকি। মটকাতে শুঁটকি ভরা হলে মটকার মুখে চূর্ণ করা শুঁটকি মাছ ও মাছের তেল দিয়ে প্রস্তুতকৃত পেস্ট দিয়ে প্রথমে একটি স্তর তৈরি করতে হয়। স্তরের উপরে মটকার মুখে সমানভাবে একটি পলিথিন কাগজ দিয়ে তার উপর নদী থেকে সংগৃহীত মাটি দিয়ে ঢেকে পলিথিন মুড়ে রাখতে হয়। এভাবে কিছুদিন রেখে দেয়ার পর মটকায় চ্যাপা শুঁটকি তৈরি হয় এবং তারপর তা বাজারজাত করা হয়।
কারিগররা জানান বংশ পরম্পরায় তারা শুঁটকি তৈরি করে আসছেন। শুঁটকি উৎপাদন করে কোন রকমে তাদের সংসার চলে, প্রতি মটকি ভরতে ২০০টাকা করে পারিশ্রমিক পান তারা। সরকারি সহায়তা এবং ক্ষুদ্র ঋণ পেলে কাজের গতি এবং জীবন মান উন্নয়ন হতো তাদের।
জেলার মেছুয়া বাজারের শুঁটকি ব্যবসায়ী অমল চন্দ্র জানান "বাজারে চ্যাপা শুঁটকির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সারাবছর চ্যাপা শুঁটকির চাহিদা থাকলে ও বর্ষাকালে বিশেষ করে বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য, আষাঢ় এ তিন মাস চ্যাপা শুঁটকি সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। আর শুঁটকির দাম বেশি হওয়ায় মানুষের আগ্রহ থাকলেও এখন শুঁটকি পরিমাণে কম কিনেন। "
বিভিন্ন হাওর ও মোহনগঞ্জ, কলমাকান্দা উপজেলার শুঁটকির বাজার থেকে কার্তিক মাস থেকে শুরু করে ৫মাস পর্যন্ত শুঁটকির স্বাদই অন্যরকম কিন্তু শুঁটকির দাম বেশি হওয়ায় এখন সাধারণ মানুষ আগের মতো শুঁটকি খেতে পারেন না।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহজাহান কবির জানান, "চ্যাপা শুঁটকি কারিগরদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়েছে এবং ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করে স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে চ্যাপা শুঁটকি তৈরি করতে সহয়তা করবেন"।