শিরোনাম
শাহজাহান নবীন
ঝিনাইদহ, ২০ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : দুই চোখের জ্যোতি হারিয়েও জীবনযুদ্ধে সফল বিস্ময়কর এক মানব আরশাদ আলী। ছয় বছর বয়সে দুই চোখের আলো হারালেও থেমে নেই তার জীবন যুদ্ধ। জীবন ধারণে সাময়িক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। অন্যান্য স্বাভাবিক মানুষের মতোই নিত্যদিনের কাজকর্ম নিজেই করেন আরশাদ।
গবাদি পশুর জন্য ঘাস কাটা, পরিবারের জন্য বাজার সদাই কেনাকাটা, সংসারের খুঁটিনাটি কাজকর্ম ও ব্যক্তিগত কাজ স্বাভাবিকভাবেই করেন। দুই চোখে দেখতে না পারলেও অন্তরের আলো দিয়েই পথ চলেন প্রতিনিয়ত।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হলিধানি ইউনিয়নের কাশিপুর গ্রামের বাসিন্দা মৃত আবুল হোসেন ও আইজান নেসা দম্পতির পুত্র আরশাদ আলী। পারিবারিক জীবনে আরশাদ আলী এক পুত্র ও এক কন্যার জনক। নয় বছর আগে তার কন্যাটি মারা যায়। বর্তমানে স্ত্রী, মা, পুত্র ও নাতিপুতি নিয়ে তার সংসার।
আরশাদ আলীর মা আইজান নেসা বাসসকে বলেন, ১৯৭২ সালে আরশাদ আলীর বয়স ছিল ছয় বছর। ওই বছর পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে গুটি বসন্ত। সেবছর এই রোগে গ্রামের অন্তত ২০ জন মারা যায়। ওই বছরই গুটি বসন্তে আক্রান্ত হন আরশাদ আলী। সঠিক চিকিৎসার অভাবে গুটি বসন্তের প্রভাবে তার দুই চোখ নষ্ট হয়ে যায়। এরপর থেকে দুই চোখে কিছুই দেখতে পান না তিনি।
দৃষ্টিশক্তিহীন আরশাদ আলী অনেক কষ্টে বড় হয়েছেন। প্রতিনিয়ত তিনি চোট পেতেন। হয়েছেন দুর্ঘটনার শিকার। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে এক বিস্ময়কর মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠেন তিনি। এখন নিজের ও সংসারের সব কাজ নিজ হাতেই করেন।
আরশাদ আলী প্রতিদিন সকালে গবাদি পশুর ঘাস নিজ হাতে কাটেন। ঘাস কাটতে চলে যান বাড়ি থেকে দূরে ঘাসের মাঠে। এসব কাজে তিনি কারো সহযোগিতা নেন না। সম্পূর্ণ অনুমানের উপরে নির্ভর করে তিনি পথ চলেন। এছাড়া নিয়মিত বাজার সদাই, কেনাকাটা ও চাষাবাদ দেখাশোনা করেন নিজেই। তবে যারা আরশাদ আলীকে চেনেন তারা সবাই তাকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করেন।
আরশাদ আলীর প্রতিবেশীরা জানান, দৃষ্টিহীনতার কারণে আরশাদ আলী কখনোই কারো কাছে হাত পাতেন নি। পরিশ্রম করে সংসার চালান। একমাত্র ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছেন। বাড়ির যাবতীয় কাজ তিনি নিজ হাতে সম্পন্ন করেন। হাঁস মুরগির ঘর তৈরি, বাঁশ ও কঞ্চি দিয়ে ঝুড়ি, কুলাসহ প্রয়োজনীয় সাংসারিক জিনিসপত্র তৈরি করেন নিজ হাতে।
সমাজকর্মী জহির রায়হান বাসসকে বলেন, আমি পেশায় রংমিস্ত্রি। আরশাদ আলীর বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে তাকে দেখে মুগ্ধ হই। একজন মানুষ সম্পূর্ণ দৃষ্টিশক্তি হারিয়েও কীভাবে নিজের কাজ নিজে করতে পারেন, এটা অবাক করার মতো। তাই তার একটি ভিডিও ধারণ করে ফেসবুকে পোস্ট করি। পরে ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে যায়।
তিনি বলেন, ‘আরশাদ আলীর কাছ থেকে আমাদের অনেক শেখার আছে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা মানসিক শক্তির কাছে কিছুই না। দৃঢ় মনোবল ও অদম্য ইচ্ছার কারণে আরশাদ আলী নিজেই নিজের কাজ করতে শিখেছেন। তিনি চাইলেই অন্যের কাছে হাত পেতে জীবন চালাতে পারতেন। আরশাদ আলী একজন বিস্ময়কর দৃষ্টি প্রতিবন্ধী।’
আত্মবিশ্বাসী এবং বিনয়ী আরশাদ আলী বাসসকে বলেন, চোখের আলো নেই তাতে কি, আল্লাহ তো আমাকে হাত পা দিয়েছেন, মুখ দিয়েছেন। নিজের ও পরিবারের যাবতীয় কাজ আমি নিজেই করি। মাঠে যাওয়া, গবাদি পশু প্রতিপালনসহ সকল কাজ আমার আয়ত্ত হয়ে গেছে। অনুমান করে সব কাজ সঠিকভাবেই করতে পারি।
তিনি আরো বলেন, সরকার থেকে প্রতিবন্ধী ভাতা পাই। কিন্তু এই ভাতা না পেলেও আমার কোনও সমস্যা হবে না। কারণ আমি কাজ করতে পারি। প্রথম প্রথম প্রতিবেশীরা আমাকে রাস্তায় চলাচলে সহযোগিতা করত। চলতে চলতে এখন সবকিছু অনুমান হয়ে গিয়েছে। ফলে চলাফেরা করতেও সমস্যা হয় না।
জীবন নিয়ে আফসোস আছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘জীবন নিয়ে আমার কোনও আফসোস নেই। আল্লাহ আমাকে যেভাবে পরিচালিত করেন, আলহামদুলিল্লাহ আমি তাতেই সন্তুষ্ট। তবে স্ত্রী-সন্তান-নাতি- পুতির মুখ দেখতে না পাওয়ায় মাঝেমধ্যে একটু কষ্ট লাগে। ’
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, ইচ্ছা শক্তি কাজে লাগিয়ে জীবন এগিয়ে নেয়া সম্ভব। শারীরিক অক্ষমতা একটা পরীক্ষা মাত্র। মনোবল ও সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা করে সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যায়। আমি সকলের কাছে আমার বাকি জীবনের জন্য দোয়া চাই।’