বাসস
  ২১ এপ্রিল ২০২৫, ১৭:৪১
আপডেট : ২১ এপ্রিল ২০২৫, ১৭:৫২

পোপ ফ্রান্সিসের প্রয়াণ: ক্যাথলিক চার্চের যুগান্তকারী অধ্যায়ের অবসান

খ্রিষ্টান ধর্মের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা, ২১ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস): খ্রিষ্টান ধর্মের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস মারা গেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। এর আগে ইতালির রোমে একটি হাসপাতালে বেশ কিছুদিন তার চিকিৎসা চলে।

ভ্যাটিকান নিউজ সার্ভিস জানায়, ভ্যাটিকানের কাসা সান্তা মার্তা বাসভবনে স্থানীয় সময় রোববার সকাল ৭টা ৩৫ মিনিটে এবং বাংলাদেশ সময় সকাল ১১টা ৩৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তিনি ছিলেন প্রথম লাতিন আমেরিকান পোপ।

নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত পোপ ফ্রান্সিসকে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে বেশ কয়েকবার তার শারীরিক অবস্থা বেশ গুরুতর পর্যায়ে চলে যায়।

ভ্যাটিকান নিউজ জানায়, শ্বাসপ্রশ্বাস-সংক্রান্ত জটিলতার কারণে পোপ ফ্রান্সিসকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছিল। তবে কয়েকদিন আগে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরেন তিনি।

ভ্যাটিকান প্রেস দপ্তর তাঁকে ‘দয়ালু, সাহসী ও নৈতিকতার আলোকবর্তিকা’ হিসেবে অভিহিত করেছে।

ভ্যাটিকানের মুখপাত্র কার্ডিনাল ফারেল এক বিবৃতিতে বলেন, ‘তার পুরো জীবন ছিল প্রভু ও তার গির্জার সেবায় নিবেদিত।’

মৃত্যুর একদিন আগেও তিনি সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে হাজির হয়ে হাজারো উপাসকের উদ্দেশ্যে ‘শুভ ইস্টার’ বার্তা প্রদান করেন।

ভ্যাটিকানের দাপ্তরিক ওয়েবসাইট ‘দি হোলি সি’-এর তথ্যমতে, পোপ ফ্রান্সিসের আগের নাম জর্জ মারিও বারগোগ্লিও।

তাঁর প্রকৃত নাম ছিল হোর্হে মারিও বেরগোলিও। পোপ ফ্রান্সিসের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসে, ইতালীয় বংশোদ্ভূত এক শ্রমজীবী পরিবারে।

তার বাবা মারিও হোসে বেরগোলিও এবং মা রেগিনা সিভোরি। ইতালীয় অভিবাসী বাবা মারিও ছিলেন রেলওয়ের হিসাবরক্ষক।

যাজক হিসেবে তাঁর জীবন শুরু হয় ১৯৬৯ সালে।

১৯৬৯ সালে ধর্মযাজক হন। ১৯৯৮ সালে আর্জেন্টিনায় আর্চবিশপ হন তিনি।

তিনি ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ পোপ ষোড়শ বেনেডিক্টের পদত্যাগের পর, ১১৫ কার্ডিনালের ভোটে তিনি ২৬৬তম পোপ নির্বাচিত হন।

কেমিস্ট হিসেবে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর ধর্মের পথে পা বাড়ান জর্জ মারিও। পরে তিনি দর্শন ও ধর্মতত্ত্বে পড়াশোনা করেন।

২০১৩ সালে তৎকালীন পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট পদ ছেড়ে দিলে পোপ নির্বাচিত হন জর্জ মারিও। নতুন নাম নেন ফ্রান্সিস। দক্ষিণ আমেরিকার কোনো দেশ থেকে নির্বাচিত তিনিই প্রথম পোপ।

১২ বছর ধরে রোমান ক্যাথলিক চার্চের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে পোপ ফ্রান্সিস বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি হন। ২১ বছর বয়সে তার একটি ফুসফুসের কিছু অংশ কেটে ফেলতে হয়।

ক্যাথলিক ও নন-ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ও অন্য ধর্মের মানুষের মধ্যে ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছিলেন পোপ ফ্রান্সিস।

পোপ ফ্রান্সিস ২০১৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন।

পোপ ফ্রান্সিস চার্চকে একধরনের মানবিক ও বাস্তবতার কাছাকাছি অবস্থানে নিয়ে আসেন। তাঁর বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ও পদক্ষেপ ছিল যুগান্তকারী।

সাধারণ জীবনযাপন: তিনি ঐতিহ্যবাহী অ্যাপোস্টলিক প্রাসাদে না থেকে একটি সাধারণ অতিথিশালায় বাস করতেন।

পরিবেশ সচেতনতা: ২০১৫ সালে ‘লাউডাটো সি’ এনসাইক্লিক্যালের মাধ্যমে জলবায়ু সংকটকে নৈতিক সংকট হিসেবে উল্লেখ করেন।

সমাজ ও মানবাধিকারে অগ্রণী ভূমিকা: উদ্বাস্তু, দরিদ্র, যৌন সংখ্যালঘু এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পাশে তিনি দাঁড়িয়েছেন বারবার।

ধর্মীয় সহাবস্থান: মুসলিম, ইহুদি ও অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে তিনি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন।

চার্চ সংস্কার: যৌন নিপীড়নবিরোধী কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে অভিযুক্ত ধর্মযাজকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন।

পোপ ফ্রান্সিসের শেষকৃত্য আগামী শুক্রবার সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় অনুষ্ঠিত হবে। বিশ্বের প্রায় সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, বিশপ ও ধর্মীয় প্রতিনিধিরা এতে যোগ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী তাঁকে বাজিলিকা দে সান্তা মারিয়া মাগিওরে'র পাশে সমাহিত করা হবে।

ভ্যাটিকান সূত্রে জানা গেছে, তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচনের জন্য ১২০ জন কার্ডিনাল নিয়ে কনক্লেভ মে মাসের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে। সম্ভবত লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা কিংবা এশিয়ার কোনো তরুণ কার্ডিনাল পরবর্তী পোপ হিসেবে নির্বাচিত হতে পারেন—বিশ্লেষকদের এমন ধারণা।

পোপ ফ্রান্সিস চার্চের বহু প্রথাগত ধারণায় নরম ধারার পরিবর্তন এনেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, 'গির্জা কেবল সন্তদের জাদুঘর নয়, বরং পাপীদের আরোগ্য-নিকেতন।'

তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি ক্যাথলিক চার্চের ভবিষ্যৎ পথচলায় গভীর প্রভাব ফেলবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন সেই বিরল নেতা, যিনি ধর্মকে মানবতার সেবায় রূপান্তর করতে চেয়েছেন। তাঁর মৃত্যুতে চার্চ শুধু একজন ধর্মনেতাকে হারায়নি, বরং হারিয়েছে ন্যায়, করুণা ও প্রগতির এক অনন্য বাতিঘর।

পোপের মৃত্যুতে বিশ্ব নেতাদের শোক

ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিসের মৃতুতে শোক প্রকাশ করেছেন বিশ্বনেতারা। তার মৃত্যুতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন,আফ্রিকান ইউনিয়ন, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ইসরাইল, নেদারল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা পৃথক শোক জানিয়েছেন।

পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ।

এক বিবৃতিতে ফরাসি প্রেসিডেন্ট পোপ ফ্রান্সিসের প্রশংসা করে বলেছেন, তিনি সবচেয়ে দুর্বল ও নিম্ন শ্রেণির মানুষদের পাশে ছিলেন।

নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী ডিক স্কুফ শোক জানিয়েছেন । তিনি বলেছেন, পোপ ফ্রান্সিস সর্বোপুরি সব জনগণের মানুষ ছিলেন।

ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সভাপতি রবার্টা মেটসোলা এক বিবৃতিতে বলেছেন, পোপ ফ্রান্সিসে বিশ্বের লাখো মানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন।

ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজোগ এক বিবৃতিতে পোপের অসাধারণ উদারতার প্রশংসা করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, পোপের প্রার্থনা অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যে শিগগিরই শান্তি আসবে এবং গাজায় আটক জিম্মিরা নিরাপদে দেশে ফিরতে পারবেন।

পোপের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে ইরানও। বিশ্বের সব খ্রিষ্টান ধর্মালম্বীদের প্রতি শোক জানিয়ে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইরান ভ্যাটিকানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে।

পোপের মৃত্যুতে সুইজারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট কারিন কেলার-সাটার বলেছেন, পোপ ফ্রান্সিস একজন ‘মহান আধ্যাত্মিক নেতা, শান্তির জন্য একজন অক্লান্ত প্রবক্তা’ ছিলেন।

এছাড়া আরো শোক জানিয়েছে স্পেন ও ইতালির নেতারা।