শিরোনাম
।। বিপুল আশরাফ ।।
চুয়াডাঙ্গা, ২৪ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস): দেশের মানসম্পন্ন ভুট্ট চাষে শীর্ষে চুয়াডাঙ্গা। জেলার প্রধান ফসল ভুট্টা ঘরে তুলতে দিনরাত ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। ফুটবল মাঠ থেকে শুরু করে বাড়ির আঙ্গিনায় ভুট্টা শুকানো মাড়াই নিয়ে উৎসব মুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। কাঙ্ক্ষিত ফসল ভুট্টার দাম বেশি হওয়ায় বেজায় খুশি।
এ জেলার মোট চাষযোগ্য অর্ধেক জমিতে ভুট্টা চাষ হয়েছে। এই চাষের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে ২ লাখ ২০ হাজার কৃষক জড়িত। ফলে, প্রধান অর্থকরী ফসলের স্থান দখল করেছে ভুট্টা। কয়েক বছর ধরে লাভজনক চাষ হওয়ায় কৃষকের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটেছে।
কৃষি নির্ভরশীল জেলা চুয়াডাঙ্গা। এ জেলার মাটি ভুট্টা চাষের জন্য উপযোগী। অধিকাংশ মানুষ কৃষি কাজের সাথে যুক্ত। এক সময় এখানকার কৃষকরা ধান, পাট, আখসহ ডাল ও তৈল জাতীয় আবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কৃষকরা তাদের চাষে পরিবর্তন এনেছে। বেছে নিয়েছেন ভুট্টার আবাদ। মাটি ভুট্টা চাষের জন্য উপযোগী হওয়ায় এখানকার কৃষকরা লুফে নিয়েছেন এই চাষটি।
দিন দিন ভুট্টার আবাদ বেড়ে যাওয়ায় জেলার প্রধান অর্থকরী ফসলের স্থান দখল করে নিয়েছে। ভুট্টা চাষের ভরা মৌসুম নভেম্বর থেকে এপ্রিল। নভেম্বর মাসে বীজ বপন করা হয় এপ্রিল মাসে ঘরে উঠতে শুরু করে। এবারও জেলায় প্যাসিফিক-৯৮১, পাইনিয়ার ভি-৯২ ও ৯৬, এলিট, মিরাক্কেল, উত্তরণ, সানশাইন, সিপি বালাম, টাইগার এবং পালোয়ান এ ৯ জাতের ভুট্টা বেশি চাষ হয়েছে। বোয়ালমারী গ্রামের কৃষক শামিম বলেন, এ বছর ৬ বিঘা জমিতে ভুট্টার আবাদ করেছি। প্রতি বিঘা জমি ১২ হাজার টাকায় লিজ নিয়েছি। এছাড়াও রোপণ থেকে শুরু করে মাড়াই পর্যন্ত ১৭-১৮ হাজার টাকা খরচ হতে পারে। মনে হচ্ছে বিঘা প্রতি ৩৮-৪০ মন ভুট্টা পাবো।
জোড়গাছা গ্রামের ইউসুফ আলী বলেন, এ বছর আবহাওয়া অনুকূল ছিল। তাছাড়া অন্যান্য বার কিছু কিছু জমিতে ভাইরাস দেখা দিলেও এবার দেখা দেয়নি। আমার ১ বিঘা জমিতে ভুট্টা ছিল। আমি তাতে ৪২ মন ভুট্টা পেয়েছি। বোয়ালমারী গ্রামের ভুট্টা চাষি ডালিম মিয়া বলেন, কয়েক বছর ধরেই এই চাষটি করছি। এখনও লোকসানের মুখ দেখেনি। প্রতি বছর কম বেশি লাভবান হয়েছে। এবারও লাভের আশা করছি। গত বছরের তুলনায় এ বছর দাম মন প্রতি ২০০ টাকা বেশি। গত বছর এ সময় প্রতি মন ৯৩০-৯৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ বছর ১১৩০-১১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এখন শুরু হয়েছে ভুট্টা কাটার তোড়জোড়। প্রধান ফসল ভুট্টা ঘরে তুলতে ব্যস্ত চাষিরা। মাঠে মাঠে ভুট্টা কাটার ধুম পড়ে গেছে। এক সাথে সবাই ভুট্টা কাটায় এতে শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। সকাল ৬টা থেকে ১২টা পর্যন্ত কাজ করছে একজন শ্রমিক। তাকে দিতে হচ্ছে ৫০০ টাকা। তারপরও সময় মতো শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। ঘোলদাড়ী গ্রামের কৃষক মামুন মিয়া বলেন, শ্রমিকের যেমন সংকট রয়েছে, তেমনই ঝড় বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। তাই কাঙ্ক্ষিত ফসল তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। যার কারণে গাছ থেকে মোচা ছাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে। পরে গাছগুলো কাটা হবে। তবে, এ বছর মাড়াই মেশিন হওয়ায় কিছুটা সুবিধা হচ্ছে। মাড়াই মেশিন মালিক সেলিম জানান, মাড়াই করতে বিঘা প্রতি ৫০০ টাকা নেওয়া হয়। এখন ভরা মৌসুমে দিন রাত কাজ হচ্ছে। ২ মাস ভরপুর কাজ হবে।
গ্রামগঞ্জে ফুটবল মাঠ থেকে শুরু করে বাড়ির আঙ্গিনায় ভুট্টা শুকানো মাড়াই নিয়ে উৎসব মুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। বাড়ির মুরুব্বি থেকে শুরু করে মেয়েরা এমনকি ছোট ছোট বাচ্চারা আনন্দের সাথে ভূট্টা শুকানো, মোচা থেকে ছোড়ানো কাজ করছেন। এ প্রসঙ্গে কথা হয় মোমিনপুর গ্রামের ভুট্টা চাষি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বজলুর রহমান পিন্টুর সাথে তিনি বলেন, আমাদের এলাকার মানুষ ভুট্টা নিয়ে ব্যস্ত। যাদের বাড়িতে জায়গা আছে তারা বাড়িতেই মাড়াই ও শুকানোর কাজ করছে। যাদের বাড়িতে জায়গা নেয় তারা বিভিন্ন মাঠে শুকাচ্ছে। আমি সহ এলাকার অনেকেই মোমিনপুর স্কুল মাঠে শুকাচ্ছি। এতে ভালো লাগছে। রাতে আমরা একসাথে ভুট্টা পাহারা দেওয়ার পাশাপাশি গল্প গুজব করা হচ্ছে। রাতে সবাই মিলে পিকনিক করা হচ্ছে। এতে সম্পর্কের উন্নয়ন হচ্ছে। সব মিলিয়ে নতুন ফসল তোলার যে আনন্দ, তা উপভোগ করছি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাসুদুর রহমান সরকার বলেন, জেলায় ভুট্টা চাষে চাষিরা লাভবান হওয়ায় গত বছরের চেয়ে এ বছর ভুট্টা আবাদ বেড়েছে। অল্প পুঁজিতে অধিক লাভবান হওয়ায় ভূট্টা আবাদের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন কৃষকরা। জেলার মোট চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ৯৪ হাজার ২২২ হেক্টর। এর মধ্যে এ বছর ৪৭ হাজার ৯৫৫ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ হয়েছে। যা থেকে ৫ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপাদন হবে। এ ভুট্টা চাষের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে আড়াই লাখ কৃষক জড়িত। জেলার ভুট্টা এলাকার চাষিদের ভাগ্য উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের চাহিদা পূরণে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে এমনটা মনে করা হচ্ছে।