বাসস
  ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ২০:২৯
আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ০০:২৩

চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে প্রচারিত ৮৩৭টি ভুল তথ্য শনাক্ত : রিউমার স্ক্যানার

ঢাকা, ২৬ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশে প্রচার হয়েছে এমন ৮৩৭টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমার স্ক্যানার।

বাংলাদেশে চলমান গুজব এবং ভুয়া খবর, অপতথ্য প্রতিরোধ এবং জনগণের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়ায় দায়িত্ব পালন করা রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে এসেছে। এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন আজ প্রকাশ করেছে রিউমার স্ক্যানার।

রিউমার স্ক্যানারের ফ্যাক্ট চেক টিমের অনুসন্ধানে বেড়িয়ে আসে ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে রিউমার স্ক্যানার ভুল তথ্য শনাক্ত করেছিল ৬৫৪টি। জাতীয় ও রাজনৈতিক নানা ঘটনা আর ধর্মীয় বিভিন্ন ইস্যুর কারণে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে ভুল তথ্য প্রচারের হার বেড়েছে। এর আগের প্রান্তিকের (২০২৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর) তুলনায় এটি বেড়েছে প্রায় ২১ শতাংশ।

ফ্যাক্ট চেক অনুসন্ধান টিম জানায়, একক ব্যক্তি হিসেবে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই তার পক্ষে গিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে জড়িয়ে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-ভুয়া তথ্যের আঁতুড়ঘর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে তুমুল জনপ্রিয় এবং বহুল ব্যবহৃত প্লাটফর্ম ফেসবুক। মেটার অধীনে থাকা এই মাধ্যমটিতে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ৭৪৮টি ভুল তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে। এই হিসেবে প্রতিদিন কমপক্ষে গড়ে আটটির বেশি ভুল তথ্য প্রচারিত হয়েছে। ফেসবুকের পর একক প্লাটফর্ম হিসেবে বেশি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে মাইক্রো ব্লগিং সাইট এক্সে (১৬২টি)। এছাড়া, ইউটিউবে ১২৪টি এবং টিকটক ও ইন্সটাগ্রামে ৬৭টি করে ভুল তথ্য ছড়িয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ছাড়াও দেশের গণমাধ্যমও ভুল তথ্য প্রচারের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। গত তিন মাসে দেশের গণমাধ্যমগুলোতে ভুল তথ্য, ছবি এবং ভিডিও সম্বলিত ভুল তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে ৪২টি। এছাড়া, গত তিন মাসে ভারতীয় গণমাধ্যমে অন্তত ২০টি ঘটনায় বাংলাদেশকে জড়িয়ে ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে।

প্লাটফর্মভিত্তিক ভুল তথ্যের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে রিউমার স্ক্যানারে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এই সময়ে পুরোপুরি মিথ্যা বা ভুয়া ঘটনা সম্বলিত ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে ৫০৭টি। এছাড়া, বিভ্রান্তিকর রেটিং দেয়া হয়েছে ২২৬টি। বিকৃত রেটিং পেয়েছে ১০২টি। এছাড়া, সার্কাজম বা কৌতুক হিসেবে হাস্যরসাত্মক ঘটনাকে বাস্তব দাবির প্রেক্ষিতে ফ্যাক্ট চেক করা হয়েছে দুইটি। এসব ভুল তথ্য শনাক্তের ক্ষেত্রে তথ্য যাচাই করা হয়েছে ৩৩৩টি, ছবি যাচাই করা হয়েছে ১৬৩টি এবং ভিডিও যাচাই করা হয়েছে ৩৪১টি।

রিউমার স্ক্যানারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক ভুয়া তথ্য কমছে না। রিউমার স্ক্যানারের প্রকাশিত ফ্যাক্ট চেকগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ক্যাটাগরি হিসেবে এই তিন মাসে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে রাজনৈতিক বিষয়েই ৩৪৬টি। শতকরা হিসেবে যা প্রায় ৪১ শতাংশ। প্রথম প্রান্তিকে জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুতেও ভুল তথ্যের প্রচার দেখা গেছে নিয়মিত। এই সময়ের মধ্যে শনাক্ত হওয়া মোট ভুল তথ্যের মধ্যে যা প্রায় ২৯ শতাংশ। এই দুই ক্যাটাগরি ছাড়াও ধর্মীয় বিষয়ে গেল বছর থেকেই ভুল তথ্যের প্রবাহ বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষণীয়।

ভুয়া তথ্যের ক্ষেত্র বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক ও জাতীয় উভয় ক্ষেত্রেই ভুল তথ্যের হার বেড়েছে যথাক্রমে ৪৭ ও ৪৪ শতাংশ।

বিএনপিকে জড়িয়ে আটটি ভুল তথ্য প্রচার হতে দেখেছে রিউমার স্ক্যানার। এছাড়াও দলটির বিভিন্ন সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন এবং নেতাকর্মীদের নামে তিন মাসে ৪৬টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমার স্ক্যানার। এই সময়ের মধ্যে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে জড়িয়ে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে, যার মধ্যে ৭৮ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জড়িয়ে একই সময়ে ছয়টি (৮৩ শতাংশই ইতিবাচক উপস্থাপন) ভুয়া তথ্যের প্রচার দেখা গেছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) জড়িয়ে প্রথম প্রান্তিকে দুইটি ভুয়া তথ্য প্রচার করা হয়েছে। এছাড়া দলটির নেতাদের জড়িয়ে এই সময়ের মধ্যে প্রচার হওয়া ২০টি ভুয়া তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমার স্ক্যানার।

‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ বিষয়ে ভুয়া তথ্যের প্রচার লক্ষ্য করা গেছে। এ বছরের প্রথম তিন মাসে সংগঠনটিকে জড়িয়ে ২০টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমার স্ক্যানার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের নিয়ে একই সময়ে ৩০টি ভুয়া তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলমকে নিয়ে ১০টি করে, খান তালাত মাহমুদ রাফি ও নুসরাত তাবাসসুমকে জড়িয়ে তিনটি করে এবং হাসিব আল ইসলাম, তিলোত্তমা ইতি, উমামা ফাতেমা ও আব্দুল হান্নান মাসুদকে জড়িয়ে একটি করে ভুল তথ্য প্রচার দেখেছে রিউমার স্ক্যানার।

অন্তর্বর্তী সরকারকে নিয়ে ধারাবাহিক অপপ্রচার শনাক্ত করেছে রিউমার স্ক্যানার। গণ-আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারকে জড়িয়েও ধারাবাহিকভাবে ভুল তথ্যের প্রচার হয়ে আসছে। গেল বছর এই সরকারকে জড়িয়ে প্রচার হওয়া ১৩৫টি ভুল তথ্য শনাক্ত করে রিউমার স্ক্যানার। একই সময়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে জড়িয়ে ছড়ায় ১১০টি ভুল তথ্য। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে এই সরকারকে জড়িয়ে ৪৪টি ভুল তথ্যের প্রচার করা হয়েছে। এসবের মধ্যে ৯৩ শতাংশ ভুয়া তথ্যের উপস্থাপনই ছিল সরকারের জন্য নেতিবাচক। এছাড়া, গেল তিন মাসে ড. ইউনূসকে জড়িয়ে ৫১টি ভুয়া তথ্যের প্রচার করা হয়েছে, যার মধ্যে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সবমিলিয়ে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে গত মার্চ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারকে জড়িয়ে ১৭৯টি ভুল তথ্যের প্রচার করা হয়েছে। একই সময়ে ড. ইউনূসকে জড়িয়ে প্রচার করা হয়েছে ১৬১টি ভুল তথ্য। সরকারের নয়জন উপদেষ্টা এবং প্রেস সচিব শফিকুল আলমকে জড়িয়ে গেল তিন মাসে সর্বমোট ৩৪টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে।

রিউমার স্ক্যানারের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভুয়া তথ্যের নিয়মিত শিকার হয়ে উঠেছে বাহিনীগুলো। দেশে সশস্ত্র এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জড়িয়ে এ বছরের প্রথম প্রান্তিকে ৬০টি ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণ পেয়েছে রিউমার স্ক্যানার। এর মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে সর্বোচ্চ ৪২টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। বাহিনীটির বর্তমান প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে নিয়ে ১১টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমার স্ক্যানার।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতীয় গণমাধ্যমের অপপ্রচার কমছে না। গত বছর থেকে ভারতীয় গণমাধ্যম এবং ভারত থেকে পরিচালিত বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশকে জড়িয়ে ভুয়া তথ্য প্রচারের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বছরের প্রথম প্রান্তিকেও এই ধারাবাহিকতা দেখেছে রিউমার স্ক্যানার। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ সম্পর্কিত ২০টি ঘটনায় ভারতের ২৩টি সংবাদমাধ্যমে ৩৮টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি আটটি ভুল তথ্য প্রচারের কারণে এই তালিকায় সবার উপরে আছে ‘আজতক বাংলা’।  এছাড়া ১৫টি ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতীয় অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে বাংলাদেশকে নিয়ে ভুয়া তথ্যের প্রচার করা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক ভুল তথ্য প্রচারের বিষয়টি গেল কিছু মাস ধরেই আলোচনায় রয়েছে। ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে এমন ৭৮টি সাম্প্রদায়িক ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমার স্ক্যানার। এর মধ্যে ৪৮টি ঘটনাতেই (৬১ শতাংশ) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতীয় পরিচয়ধারী অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে প্রথম তিন মাসে ৮৩টি ভুল তথ্যের প্রচারে ভারতীয়দের ভূমিকা দেখেছে রিউমার স্ক্যানার।