বাসস
  ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৭:৩৯

ভাষা আন্দোলনে ফেনীতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন খাজা আহমদ

॥ আরিফুল আমীন রিজভী ॥
ফেনী, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ (বাসস) : রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকার সঙ্গে ফেনীও সমস্বরে আন্দোলন করেছে। তখন উত্তাল ছিল ফেনী। আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা খাজা আহমদ। তিনি ভাষা আন্দোলনের জন্য জেল খেটেছেন, তাঁর
প্রকাশিত পত্রিকা বাজেয়াপ্ত করেছিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকার।
গণমাধ্যম, একাধিক গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, ভাষা আন্দোলনে অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন ফেনীর বীর খাজা আহমদ। আপসহীন মানুষটি ভাষার জন্য লড়েছেন গণমাধ্যমকর্মী হয়ে, রাজপথে লড়াকু সৈনিক হয়ে।
মুদ্রণশিল্পের কথা, অতীত ও বর্তমান গ্রন্থে দেখা যায়, ১৯৪৮ সালে খাজা আহমদ সংগ্রাম নামে একটি স্থানীয় পত্রিকা প্রকাশ করেন। সংবাদপত্রটি শুরু থেকেই পাকিস্তানের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। যদিও হুবহু কোন কপি পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন লেখকের কলমে উঠে এসেছে অকুতোভয় এ ভাষা সৈনিকের কথা।
ফেনী হতে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সংগ্রামে নিয়মিত স্থান পেত রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনের খবর এবং প্রবন্ধ। গ্রন্থটিতে দেখা যায়, মাস্টার পাড়ায় সুজাত প্রেস নামে একটি ছাপাখানা হতে সংগ্রাম পত্রিকাটি প্রকাশিত হত। গ্রন্থটিতে ভাষা আন্দোলনে মুদ্রণশিল্পের ভূমিকা অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে।
শুরু থেকেই তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ভালভাবে নেয়নি সাপ্তাহিক সংগ্রাম পত্রিকাটিকে। খাজা আহামদ নিজেই তখন ফেনীতে ভাষা আন্দোলনের অগ্রনায়ক। বলা হয়ে থাকে সাপ্তাহিক সংগ্রাম যুবাদের আন্দোলনে উদ্বুদ্ধকরণে ভূমিকা রাখত।
২০১৭ সালে ভাষা আন্দোলনে ফেনী শিরোনামে 'অন্যপক্ষ' ম্যাগাজিন প্রকাশ করে। এতে উপেক্ষিত খাজা আহামদ শিরোনামে একটি লেখায় বলা হয়, একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষা সৈনিক বিচারপতি কাজী এবাদুল হক স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন- খাজা আহামদের নেতৃত্বে আমরা ভাষা আন্দোলনে অংশ নেই। তিনি তখন ভাষা সংগ্রামের আহবায়ক।
কাজী এবাদুল হক কোন সালের কথা বলেছেন তা এখানে স্পষ্ট হয়নি। তবে সমসাময়িককালে খাজা আহম্মদ নোয়াখালী জেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন বলে ফেনীর ইতিহাস গ্রন্থে জমির আহমেদ উল্লেখ করেন। উল্লেখ্য যুবলীগ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের যুব সংগঠন। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।
'ফেনী ছিল ভাষা আন্দোলনে উত্তাল জনপদ' শিরোনামে রফিকুল ইসলামের একটি তথ্যবহুল নাতিদীর্ঘ লেখা, আমানুল্লাহ কবীর এবং ফাইজুল ইসলাম সম্পাদিত 'জেলায়-জেলায় ভাষা আন্দোলন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ' বইতে ছাপা হয়। এতে লেখক বাংলাদেশের প্রবীন সাংবাদিক ও ফেনীর কৃতি সন্তান মরহুম এবিএম মুসার দেয়া একটি তথ্য উল্লেখ করেন। এবিএম মুসার উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা হয়, রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে তাঁর একটি প্রবন্ধ ছাপানোয় সাপ্তাহিক সংগ্রাম পত্রিকার ওই সংখ্যার সব কপি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল।
ভাষা আন্দোলন চলাকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে যে কয়টি স্থানীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকা ভূমিকা রেখেছে 'সংগ্রাম' তন্মধ্যে অন্যতম।
বদর উদ্দিন উমরের 'পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি' গ্রন্থমালার দ্বিতীয় খন্ডের পঞ্চম পরিচ্ছদে ২১টি পত্রিকার নাম উল্লেখ করেন। এরমধ্যে  ফেনীতে সংগ্রাম পত্রিকার উল্লেখ রয়েছে।
সংগ্রাম বীরদর্পে ভাষা আন্দোলনের খবর খুব বেশিদিন ছাপতে পারেনি। এরই মধ্যে নেমে আসে নিষিদ্ধের খড়গ। ১৯৫০ সালে আন্দোলনে নেতৃত্বের অপরাধে গ্রেফতার হন খাজা আহামদ। বদর উদ্দিন তাঁর একই গ্রন্থের একই পরিচ্ছদে উল্লেখ করেন, ১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে ফেনী থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সংগ্রাম পত্রিকার সম্পাদক খাজা আহাম্মদকে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। এই গ্রেফতারের প্রতিবাদে ২ নভেম্বর নওবেলাল-এ 'দুর্ভাগা সাংবাদিক' নামে একটি দীর্ঘ ও কঠোর সমালোচনামূলক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।
গ্রন্থে উল্লেখিত সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, সরকারের হাতে 'আইন'- সাংবাদিকের হাতে 'জনমত' এই দু’টির পরস্পর বিরোধী শক্তি পরীক্ষা চলিয়াছে- সত্যিকারের জনমতকে ব্যক্ত করিবার অধিকার সাংবাদিকের নাই।... ডানে আমাদের শত্রু-বামে আমাদের শত্রু-তারই মধ্যে সংগ্রাম সম্পাদক একটি বলি মাত্র।
শিক্ষবিদ মরহুম কামাল হাসান চৌধুরী তাঁর আত্মজীবনী জীবনের ধারাপাত গ্রন্থে লিখেছেন, সংগ্রামে প্রকাশিত খবর সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা যোগাত। আমরা ধলিয়া স্কুলে কাগজটি সবাই মিলে পড়তাম। বিভিন্ন সমজিদ মক্তবে খবরগুলো দেখাতাম। কারণ একটি মহল মানুষকে বোঝাতো, বাংলা বিধর্মীদের ভাষা।
ফেনীর রাজা খ্যাত মরহুম খাজা আহম্মদ ১৯২০ সালে ফেনী শহরের রামপুরে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত অনুসারী। ১৯৭০ সালে আইন পরিষদে ও ১৯৭৩ সালে জাতীয় নির্বাচনে তৎকালীন নোয়াখালী-২ আসন হতে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ফেনী মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন।