ঢাকা, ২২ মে, ২০২২ (বাসস) : মাহফুজা মিনা, বাড়ি পাবনা জেলার পবা উপজেলার বনগ্রামে। বাবা মৃত আবদুল মজিদ। পড়াশোনা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করে যোগ দেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে। এর মাঝে বিয়েও হলো। স্বামী প্রকৌশলী। তাদের রয়েছে দুই সন্তান।
চাকরি, সংসার বেশ ভালোভাবেই চলছে। কিন্তু কোথায় যেন একটা ‘শূন্যতা’ অনুভব করেন মিনা। করবেনইতো মনে যার উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন তার কী আর ৯-৫টা চাকরিতে মন বসে?
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাকরি ও সংসার সামলে তিনি শুরু করেন ডেইরি ফার্ম। ২০১০ সালে মাত্র দুটি গরু নিয়ে শুরু হয় তার ফার্মের কার্যক্রম। ক্ষুদ্র থেকে যে কাজ শুরু, সেখান থেকে এখন তিনি সফল উদ্যোক্তা। তার ফার্মে রয়েছে ৫০টিরও বেশি গরু। আছে ভেড়া-ছাগল ও হাঁস-মুরগি। এর মাঝে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোক্তা পুরস্কারও অর্জন করেছেন। এলাকায় অন্য নারীদের উদ্যোক্তা ‘আইকন’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন মিনা।
লুৎফা সানজিদা। চট্টগ্রাম নগরীর এই গৃহবধূর ব্যবসা শুরুর পুঁজি ছিল মাত্র ১৫ হাজার টাকা। এই পুঁজি দিয়ে শিশু পোশাক ও পাঞ্জাবি তৈরি করে স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করতেন তিনি। পরে তার আগ্রহ দেখে এগিয়ে আসেন এক আত্মীয়। ৩০ হাজার টাকা ধার নিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর চকভিউ মার্কেটে নিজের পণ্যের একটি শো রুম দেন তিনি।
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। সাফল্য আসতে থাকে। এখন ‘অনিন্দ্য বুটিক হাউস’ ও ‘অনিন্দ্য বিউটি পার্লার’ নামে স্বত্বাধিকারী তিনি।
১৫ হাজার টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করে আজ তিনি সফল উদ্যোক্তা, কোটিপতি। তার সংগ্রামের সাফল্য তুলে ধরা হয়েছে নবম-দশম শ্রেণির ব্যবসায় উদ্যোগ বইয়ে। ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতেই চট্টগ্রামের সফল নারী উদ্যোক্তা ও ফ্যাশন ডিজাইনার লুৎফা সানজিদার বর্ণাঢ্য জীবনী তুলে ধরা হয়েছে বইটির দ্বাদশ অধ্যায়ে।
আরেক সফল উদ্যোক্তা নূরুন্নাহার বেগম, তার বাড়িও পাবনার ঈশ্বরদী। জাতীয় কৃষি স্বর্ণপদক জিতেছেন তিনি। উদ্যোক্তা হিসেবে পুরস্কারের ডালি যেন তার হাতেই! ২০১১ সালে দেশের নারী কৃষক হিসেবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি ব্রোঞ্জ পদক, ২০১৬ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি স্বর্ণপদক, ২০১৭ সালে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে এক লাখ টাকাসহ রাঁধুনি কীর্তিমতী অ্যাওয়ার্ড, একই বছর জাতীয় সবজি পদক, ২০১৮ সালে কে আই বি পদকও তার ঘরে।
এর আগে সবজি, ফলমূল, পোলট্রি ও গাভীর খামার করে এলাকার নারীদের কৃষিকাজে উদ্বুদ্ধ করে ২০১০ সালে সিটি গ্রুপ জাতীয় পুরস্কার হিসেবে সাড়ে তিন লাখ টাকা, একটি সার্টিফিকেট এবং একটি ২৪ ইঞ্চি রঙিন টেলিভিশন পুরস্কার লাভ করেন নুরুন্নাহার।
নুরুন্নাহার বেগমের বাড়ি ঈশ্বরদী উপজেলার ছলিমপুর ইউনিয়নের বক্তারপুর গ্রামে। স্বামীর নাম রবিউল ইসলাম। তিনি ‘জয় বাংলা নারী উন্নয়ন মহিলা সমবায় সমিতি’ ও এনসিডিপি গ্রাম উন্নয়ন কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করা নূরুন্নাহার এক হাজারের বেশি নারীকে সংগঠিত করে তাদের স্বাবলম্বী করে তুলেছেন।
শুধু মিনা কিংবা নূরুন্নাহারই নন, তাদের মতো দেশজুড়ে ছোট-বড় নানা উদ্যোগ নিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন বাংলাদেশের নারীরা।
জানা যায়, বাংলাদেশে মোট উদ্যোক্তার শতকরা ৩১.৬১ শতাংশ নারী। নারী উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে বিশে^র অন্য অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। পরিবার, আর্থ-সামাজিক অবস্থান, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ, পারস্পরিক সহযোগিতা, আর্থিক সহায়তা এবং ব্যবসায়িক পরিবেশের নানা চ্যালেঞ্জ থাকা স্বত্ত্বেও নারী উদ্যোক্তারা দৃঢ়তার সঙ্গে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সূত্র জানায়, নারী উদ্যোক্তার এই বিপুল সম্ভাবনা শুধু শহর কেন্দ্রিক নয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও দেখা মেলে হাজার হাজার নারী উদ্যোক্তার। যারা সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে। সরকারের পক্ষ থেকেও নানা ধরনের সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, নারী ও পুরুষের সমতা ছাড়া দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। শিক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না হলে সমাজে নারীদের অবস্থান সুসংহত হয় না। এ জন্য নারীদের আত্মসম্মানবোধ বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন,‘৪০ লাখ নারী শ্রমিক দেশের তৈরি পোশাক খাতকে সচল রাখছেন। তারা কারখানার মালিক নন। ৪০ লাখ নারী উদ্যোক্তা তৈরি হলে তারা দেশের অর্থনীতিকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ৫ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকার বেশি নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে এসএমই ঋণ বিতরণ করেছে। এর মাধ্যমে ১৩ হাজার ৭৪২ জন নতুন নারী উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, এ পর্যন্ত এসএমই খাতে ব্যাংকগুলো মোট ঋণ দিয়েছে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার বেশি।
সূত্র বলছে, নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের কথা ভেবে আওয়ামী লীগ তাদের প্রতিটি ইশতেহারে নারী বিষয়ে বিশেষ পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দিয়ে থাকে, যা নারী উদ্যোক্তাদের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক।
বর্তমান সরকারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও নারীর উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে সামনে রেখে ইশতেহারে বেশকিছু উল্লেখ করা হয়, ‘জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ’ এবং রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা। এসব উদ্যোগের ফলে দেশে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি দৃশ্যমান। সরকার গৃহীত সুবিধা নিয়ে অনেক নারীই আজ উদ্যোক্তা হিসেবে পুরুষের সঙ্গে সমানভাবে প্রতিষ্ঠিত।
মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, নারীদের মেধা, যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা অনেক বেশি। কিন্তু সুযোগের অভাবে তাদের মেধার বিকাশ হচ্ছে না। পুরুষ যদি কোটি টাকার ব্যবসা করতে পারেন, তাহলে নারীও পারবেন। নারীকে উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করার জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, চাকরি দেয়ার চেয়ে একজন উদ্যোক্তা তৈরি করা অর্থনীতির জন্য বেশি কার্যকর। কারণ একজন উদ্যোক্তা ব্যবসা শুরু করার পর প্রতি বছরই নতুন নতুন মানুষকে চাকরি দিতে পারবেন। এতে বেকারত্ব কমবে এবং মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হবে।
নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দেশে কার্যরত ব্যাংকগুলোর প্রত্যেকটি শাখাকে নতুন তিনজন নারী উদ্যোক্তাকে ঋণ দেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।’
‘নারী উদ্যোক্তাদের বিশেষ ক্ষেত্রে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জামানত ছাড়াই ঋণ দেয়ার সুযোগ আছে,’ যোগ করেন গভর্নর।