বাসস
  ২৫ এপ্রিল ২০২৩, ২০:০৫

আইএজিএস-এর ঘোষণা ১৯৭১-এর জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের পথে বড় অর্জন : মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী

॥ মাহফুজা জেসমিন ॥
ঢাকা, ২৫ এপ্রিল, ২০২৩ (বাসস) : ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্স (আইএজিএস) ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় ৭১’এর জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের পথে বাংলাদেশ আরো এক ধাপ এগিয়েছে বলে মতামত দিয়েছেন রাজনীতিক, জেনোসাইড বিশেষজ্ঞ, জেনোসাইড এক্টিভিস্ট এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তানেরা।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি বলেন, এই স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের পথে আমাদের আরো এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। এটি আমাদের বড় অর্জন। এই অর্জনকে সঙ্গে নিয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও জাতিসংঘের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য আমাদের ধারাবাহিক কর্মপ্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। তিনি বাংলাদেশ জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলনে জড়িত বিশেষজ্ঞ, গবেষক, এক্টিভিস্টদের অভিনন্দন জানান।
জেনোসাইড বিশেষজ্ঞদের আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএজিএস ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞকে ‘জেনোসাইড, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধ’ ঘোষণা করে প্রস্তাব পাস করেছে। গতকাল ২৪ এপ্রিল সোমবার আইএজিএস-এর পক্ষ থেকে ভোটের ফলাফলের ভিত্তিতে বাংলাদেশে সংঘটিত জেনোসাইড সংক্রান্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে বলে সিদ্ধান্ত জানানো হয়। ভোটদাতা ২১৮ জন সদস্যের মধ্যে ২০৮ জন প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন, যার মাধ্যমে এই প্রস্তাব নিরঙ্কুশ সমর্থনে পাস হয়। এ ঘোষণার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে একাত্তরে সংঘটিত গণহত্যার বিশ্বজনীন স্বীকৃতির প্রয়াসে তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ গৃহীত হলো।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের জনগণ, বাংলাদেশ সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আইএজিএস-এর এ স্বীকৃতির জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘অনেক দেরিতে হলেও তারা অনুধাবন করতে পেরেছেন যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ওপর কি নির্বিচার হত্যাকান্ড ও জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছে। এজন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই এবং আশা করি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের ক্ষেত্রেও তাদের এই সমর্থন ও প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’
বাসস-এর সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘যারা কোনোভাবেই যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিলনা, সেইসব সাধারণ নিরীহ, নির্বিরোধী মানুষ এমনকি নারী ও শিশুদের ওপর পাকিস্তান বাহিনী যে নির্বিচার হত্যাকান্ড পরিচালনা করেছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। এত কম সময়ে এত হত্যাকান্ডের ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর নেই।’
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি এবং আইএজিএস-এ এই প্রস্তাবের সহ-উদ্যোক্তা মফিদুল হক বাসসকে বলেন, ‘আইএজিএস-এর এই স্বীকৃতি আমাদের দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতিফলন, ধারাবাহিক কাজের পরিণতি। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের একটি বড় অর্জন। এই অর্জনের মধ্যে দিয়ে আমাদের কাজ এবং দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেলো। এখন জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য আমাদের আরো জোরালো ও সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশের জেনোসাইড ইতিহাসের নিষ্ঠুর সত্য ঘটনা। যা ভূ-রাজনৈতিক কারণে বিস্মৃত জেনোসাইডে পরিণত হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণে এই জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায় এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ঘোষণা দেন। সেসময় ১৯৫ জনকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে শনাক্ত করাও হয়। কিন্তু নানা রাজনৈতিক চাপে তখন বিচার করা সম্ভব হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল’ গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করে। এটি ছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ জেনোসাইড বিষয়ক একটি বড় অর্জন। এর মধ্যে দিয়ে একদিকে যেমন স্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শুরু হলো, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের কাজও শুরু করা হয়।
মফিদুল হক জানান, জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর  ‘সেন্টার ফর দ্য স্ট্রাডি অব জেনোসাইড এন্ড জাস্টিস (সিএসজিজে)’ প্রতিষ্ঠা করে। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম এবং তরুণ গবেষকরাও জেনোসাইড নিয়ে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে।      
তিনি বলেন, আগামী জুলাইতে বার্সেলোনাতে আইএজিএস আয়োজিত ১৬তম দ্বিবার্ষিক সম্মেলন ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন জেনোসাইড এ্যান্ড জাস্টিস’-এ আইএজিএস-এ স্বীকৃত হওয়া রেজুলেশন নিয়ে আলোচনা করা হবে।  
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন আমরা একাত্তরের চেয়ারপারসন বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব জামান আইএজিএস- কে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এটি একটি বিরাট অর্জন। এর আগে লেমকিন ইন্সটিটিউট, জেনোসাইড ওয়াচসহ আরো তিনটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশ জেনোসাইডের স্বীকৃতি দিয়েছে। কানাডা সরকারিভাবে বেশ কিছু উদ্যোগ নিচ্ছে। হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে গাম্বিয়ার  প্রেসিডেন্টের আনীত মামলা চলছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এ বিষয়ে তৎপর।  আইএজিএস-এর এই স্বীকৃতির মধ্যে দিয়ে আরো একটি সংস্থা যুক্ত হলো। যা বাংলাদেশ জেনোসাইডের জাতিসংঘের স্বীকৃতি আদায়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
তিনি জানান, আগামী ২২ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ জেনোসাইডের স্বীকৃতির দাবিতে আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। এতে সরকারের নীতি-নির্ধারক, দেশ-বিদেশের জেনোসাইড বিশেষজ্ঞ এবং     এক্টিভিস্টরা অংশ নেবেন।  
প্রজন্ম একাত্তরের সভাপতি শহীদ মুনীর চৌধুরীর পুত্র আসিফ মুনীর বাসসকে বলেন, আইএজিএস-এর সদস্যরা অতীতে নিজেদের গবেষণায় বাংলাদেশকে সমর্থন করলেও একটি সম্মিলিত প্লাটফর্ম থেকে এই স্বীকৃতি অর্জন একটি বড় অর্জন।  এই স্বীকৃতিকে আমাদের কৌশল হিসেবে কাজে লাগাতে হবে।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ক্ষেত্রে বিরোধীতা থাকবে। রাজনীতিক, বিশেষজ্ঞ, গবেষক, এক্টিভিস্ট, নাগরিক সমাজ সবাই মিলে সম্মিলিতভাবে স্বীকৃতি আদায়ে উপযুক্ত কৌশল চিন্তা করতে হবে।
আইএজিএস-এর নির্বাহী পরিষদে প্রস্তাবনা পেশ করেন শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজুদ্দিন হোসেনের পুত্র জেনোসাইড বিশেষজ্ঞ তৌহীদ রেজা নূর। তিনি বলেন, ‘এই স্বীকৃতি আদায়ের যাত্রাপথে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে বাংলাদেশ সরকারকে এ বিষয়ে একটি কার্যকর রোডম্যাপ (যথাযথ পরিকল্পনা) তৈরি করতে হবে।’
তিনি বিভিন্ন দেশের সংসদে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে যে জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছিলো, সে ব্যাপারে রেজ্যুলেশন পাস করার অনুরোধ জানানো ও তা আদায় করার বিষয়ে নিরবচ্ছিন্ন ফলোআপ করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে দায়িত্ব নেয়ার পরামর্শ দেন।
প্রজন্ম একাত্তরের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক তৌহীদ রেজা নূর মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীদের এই স্বীকৃতি আদায়ের ক্যাম্পেইনে যুক্ত করার আহ্বান জানান।  
শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. ফজলে রাব্বির কন্যা ড. নুসরাত রাব্বি আইএজিএস-এর স্বীকৃতিতে আশা প্রকাশ করে বলেন, এই স্বীকৃতি পেতে আমাদের অনেক দিন লেগেছে। সামনে আমাদের আরো অনেক কাজ। পাকিস্তানকে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। তিনি আন্তর্জাতিক আদালতে পাকিস্তানের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি জানিয়ে বলেন, বিশ্বের বড় বড় হলোকাস্ট মিউজিয়ামে ১৯৭১ এর হত্যাকান্ডের চিহ্ন, দলিল ও ইতিহাস স্থায়ীভাবে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে।