শিরোনাম
॥ মনোজ কুমার সাহা ॥
টুঙ্গিপাড়া (গোপালগঞ্জ) ,৮ মে, ২০২৩ (বাসস) : গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া-কোটালীপাড়া উপজেলার নিন্ম অঞ্চলের ২০০ একর জমিতে সমলয় পদ্ধতিতে ধান চাষ করে কৃষকরা লাভবান হয়েছেন।বছরের অধিকাংশ সময় এসব জমি পানির নিচে থাকত। সারা বছরই কচুরিপানা, জলজ জঞ্জালে জলাবদ্ধ অনাবাদি থাকা এসব বিলের জমিতে এখন সোনালী ধান দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহবোনে এ জমিতে জলজ জঞ্জালের পরিবর্তে ফলেছে সোনালী ধান । গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার কুশলী ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর, পাটগাতী ইউনিয়নের পুবের বিল, কোটালীপাড়া উপজেলার রাধাগঞ্জ ইউনিয়নের আটাশীবাড়ী ও কান্দি ইউনিয়নের তালপুকুরিয়া-কান্দি গ্রামের জলাবদ্ধ আনাবাদি ২০০ একর জমিতে সমলয় পদ্ধতিতে ধান চাষাবাদ করা হয়।
সরকারের নেওয়া ‘সমলয়’ চাষাবাদ প্রকল্পের আওতায় পরীক্ষামূলকভাবে একাধিক কৃষকের অনাবাদি ২০০ একর জমি নিয়ে আবাদযোগ্য করে তোলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। সমলয়ে উৎপাদিত ধান জমির মালিককে ইতিমধ্যে কেটে দেওয়া হয়েছে । এ পদ্ধতির চাষাবাদে জমির মালিককে এক টাকাও খরচ করতে হয়নি। এ প্রথম বার সমলয় চাষাবাদে সুফল পেয়েছেন কৃষক। এখন থেকে আর কেউ জমি ফেলে রাখবে না–, আগ্রহ দেখাচ্ছেন ধান চাষাবাদে। এটিই ‘সমলয়’ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক সংকটের কথা মাথায় রেখে খাদ্যের জোগান বাড়াতে দেশের এক ইঞ্চি জমি যাতে অনাবাদি না থাকে সেজন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । সেই আহ্বানে এবং তাঁরই নির্দেশে পতিত জমিতে বিভিন্ন ধরনের সবজি ও উচ্চ ফলনশীল ধান চাষ করা হয়েছে।
টুঙ্গিপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ জামাল উদ্দিন বলেন, এ বছর ১৫০ জন কৃষকের ১০০ একর যৌথ জমিতে ‘সমলয়’ পদ্ধতিতে বোরো ধানের চাষাবাদ হয়। চাষাবাদের শুরুতে ট্রেতে বীজতলা করা হয়েছে। যান্ত্রিকীকরণ ও আধুনিক চাষাবাদের এ পদ্ধতিতে কম খরচে কৃষক অধিক ধান উৎপাদন করতে পেরেছেন। হিসেব করে দেখাগেছে এ পদ্ধতির চাষাবাদে কৃষকের বিঘাপ্রতি অন্তত ১২ হাজার টাকা সাশ্রয় হয়েছে। এ পদ্ধতির চাষাবাদ সময়ও খরচ সাশ্রয়ী। এ ছাড়া বিঘাপ্রতি হাইব্রিডে ৩০ মণের স্থলে ৩৫ মণ ধান উৎপাদিত হয়েছে। উফশী জাতে ২৫ মণের স্থলে ৩০ মণ ধান উৎপাদিত হয়েছে ।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. শাজাহান কবীর বলেন, আধুনিক চাষাবাদ ও কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণের জন্য বিজ্ঞানীরা সমলয় পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। এ পদ্ধতিতে আধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে বীজতলা থেকে শুরু করে ধান মাড়াই পর্যন্ত সবই করা হয়েছে । শ্রম ও খরচ সাশ্রয়ী এ চাষের জমিতে কোনো আইল থাকে না। ফলে সংশ্লিষ্ট কৃষকদের জমিতে বীজতলা থেকে ফসল কাটা সবই একই সময়ে করা যায়। সমলয় পদ্ধতির সুবিধা অনেক।
টুঙ্গিপাড়া উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের কৃষক শাহাদত উকিল ও নাজিম মোল্লা বলেন, নতুন পদ্ধতির চাষাবাদে সবই যন্ত্রের ব্যবহার। এখানে শ্রমিক তেমন লাগে না। ধান কাটার সময় শ্রমিক সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। তখন শ্রমিককে এক হাজার টাকা মজুরি দিতে হয়। ধান নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না। এ চাষাবাদে হেক্টরে গড়ে সাড়ে ৮ টন ফলন পেয়েছি। অন্তত ১০ দিন আগে ধান ঘরে তুলতে পেরেছি । এ পদ্ধতিতে ধান চাষে আমাদের অধিক লাভ হয়েছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফার্ম মেশিনারি অ্যান্ড পোস্ট হারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ধান চাষাবাদের লক্ষ্যে খামার যন্ত্রপাতি গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধিকরণ (এসএফএমআরএ) প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম জানান, এ প্রকল্পের অর্থায়নে বাংলাদেশে এ প্রথম স্থানীয় ওয়ার্কশপে দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে হোল ফিড কম্বাইন্ড হারভেস্টার ডিজাইনও তৈরি করেছেন ব্রির বিজ্ঞানীরা। দেড় বছর ধরে গবেষণা করে যন্ত্রটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। বিশেষ করে হাওর অঞ্চলকে টার্গেট করে যন্ত্রটি উদ্ভাবন করা হয়। কারণ, বোরো মৌসুমে শ্রমিক সংকট এবং পাহাড়ি ঢলে প্রচুর ফসল নষ্ট হয়। ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, আমন এবং বোরো উভয় মৌসুমেও এ যন্ত্র দিয়ে ধান কাটা যাবে।
কোটালীপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নিটুল রায় বলেন, আমরা আটাশীবাড়ী ও তালপুকুরিয়া ও কান্দি গ্রামের ১৫০ জন কৃষকের সংগঠিত করে ১০০ একর জমিতে সমলয় পদ্ধতিতে ধান চাষাবাদ চাষাবাদ করি। ইতিমধ্যে আমরা কৃষকের ধান কেটে ঘরে তুলে দিয়েছি। সমলয় হল যান্ত্রিক পদ্ধাতিতে ধান চাষ। এ পদ্ধতির চাষাবাদে কৃষকের শ্রম ও খরচ সাশ্রয় হয়েছে। এটি আমরা হাতে কলমে কৃষকে দেখাতে সক্ষম হয়েছি। এ বছর কোটালীপাড়ায় প্রথম এ পদ্ধতির চাষাবাদ হয়েছে। আরো ১০ দিন আগে কৃষক ঘরে ধান তুলেছে। তাই এ পদ্ধতির লাভ জনক ধান চাষে কৃষক ব্যাপক আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
কোটালীপাড়া উপজেলার কান্দি গ্রামের কৃষক সুকান্ত মধু বলেন, এ পদ্ধতিতে ১ একর অনাবাদি ও জলাবদ্ধ জমিতে ধানের বাম্পার ফলন পেয়েছি। চাষাবাদ হয়েছে যান্ত্রিকভাবে। এ পদ্ধতির চাষবাদ আমাদের এলাকার সব কৃষককে আকৃষ্ট করেছে। তাই আগামী বছর এ পদ্ধতিতে অন্তত ৫ একর জমিতে ধান চাষ করব।