বাসস
  ১০ মে ২০২৩, ১৬:১৯

চট্টগ্রাম ওয়াসার পানির লবণাক্ততা নিরসনে আপাত সমাধান বৃষ্টি, প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদে সমন্বয় ও নতুন পরিকল্পনা

॥ কলিম সরওয়ার ॥
চট্টগ্রাম, ১০ মে, ২০২৩ (বাসস) : চট্টগ্রাম ওয়াসার সরবরাহ করা পানিতে চলমান লবণাক্ততা সমস্যা নিরসনে আপাত সমাধান বৃষ্টি হলেও দীর্ঘমেয়াদে প্রয়োজন সমন্বয় ও নতুন করে পরিকল্পনার। ওয়াসার পানির বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ ও সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে এই ধারণা পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৃষ্টি না হওয়ায় ওয়াসার পানির মূল উৎসস্থল হালদা নদীতে পানির প্রবাহ কমে গেছে। বৃষ্টিতে বিস্তীর্ণ এলাকার পাহাড়ের পানি কাপ্তাই হ্রদ হয়ে কর্ণফুলী নদীর মাধ্যমে হালদায় আসে। এতে পানির এ আধারে নি¤œমুখী প্রবাহ থাকে। কিন্তু চলতি মে মাস পর্যন্ত বৃষ্টি না হওয়ায় কাপ্তাই হ্রদে পানির প্রবাহ কমে গেছে। এতে করে সমুদ্রের পানি ঢুকে পড়ে এ দু’টি নদীতে লবণাক্ততার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে উৎসস্থলের পানি প্রক্রিয়াজাত করে ওয়াসা নগরীতে সরবরাহ করলেও তাতে লবণাক্ততা আশানুরূপ কমানো যাচ্ছে না।
এছাড়া কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্বাভাবিকের অনেক নিচে নেমে গেছে পানির স্তর। তারা একটি টারবাইন চালু রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। যদিও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে ২০১৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর পত্রের মাধ্যমে প্রতি বছর নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত দু’টি টারবাইন চালু রাখার জন্য জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষকে স্থায়ী নির্দেশ দেয়া রয়েছে। অন্যদিকে ওয়াসা পানি পরিশোধনের জন্য যে পরিমাণ বিদ্যুৎ নিরবচ্ছিন্নভাবে পাওয়ার কথা তাও পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে ওয়াসাকে কখনো বিদ্যুৎ, আবার কখনো জেনারেটরের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। দিনে অনেকবার বিদ্যুতের উৎস পরিবর্তনের কারণে সময়ের অপচয়ের সাথে সাথে পরিচালন ব্যয়ও বাড়ছে। আবার এতে উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া ওয়াসার পানি সংগ্রহের উৎসস্থল হালদা নদীর ওই অংশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পল্লী বিদ্যুৎ। প্রকল্প শতভাগ পরিচালনার জন্য ওয়াসার চাহিদার পুরোটা নিরবচ্ছিন্নভাবে সরবরাহের সক্ষমতাও পল্লী বিদ্যুতের নেই। এ জন্য গুরুত্ব বিবেচনা করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-এর ডেডিকেটেড লাইনের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল রাখা প্রয়োজন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ডেেিকটেড লাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা আছে।
কর্ণফুলীর উজান থেকে পানির প্রবাহ ঠিক রাখতে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে পানি পরিশোধনাগার পরিচালনার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগের সাথে চট্টগ্রাম ওয়াসার স্থায়ী সমন্বয় জরুরি। ওয়াসা গত কয়েক বছর ধরে এ চেষ্টা চালিয়ে গেলেও এখনো সফল হতে পারেনি।   
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বাসস’কে জানান, কর্ণফুলী নদীর উজান থেকে আসা পানির জোর প্রবাহ না থাকায় বাধাহীনভাবে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ছে নদীতে। অথচ ওপর থেকে নেমে আসা নদীর পানিতে জোরালো প্রবাহ থাকলে সাগরের পানি নদীর পানির সাথে মিশতে বাধা পায়। এছাড়া, কাপ্তাই রাবার ড্যাম থেকে কর্ণফুলী নদীতে শেওলা ঢুকে পড়ছে। এখান থেকে পানি পরিশোধনের জন্য নিতে গেলে শেওলা আটকে যাচ্ছে পানির লাইনে। সমুদ্রের লবণ পানি নদীতে ঢুকে পড়ার কারণে জোয়ারের সময় পরিশোধনের জন্য পানি নেয়া যাচ্ছে না। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। কারণ আপাতত বৃষ্টিই এই লবণাক্ততার একমাত্র সমাধান।
চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি সংগ্রহের উৎসস্থলে গত সপ্তাহে গড়ে লবণাক্ততার মাত্রা ছিল প্রতি লিটারে ৩ হাজার মিলিগ্রামের বেশি। এটিকে সহনীয় মাত্রায় এনে প্রতি লিটারে ৪০০ মিলিগ্রাম লবণ-সম্পন্ন পানি সরবরাহ করা হচ্ছে বলে জানান চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী।
এদিকে চট্টগ্রাম ওয়াসার পক্ষ থেকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সচিব বরাবরে সার্বিক বিষয় অবগতকরণ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে গত ২১ মার্চ একটি পত্র দেয়া হয়।
এতে বলা হয়, ‘মোহরা পানি শোধনাগার ও শেখ রাসেল পানি শোধানাগার হতে দৈনিক ১৮০ এমএলডি পানি পরিশোধনপূর্বক চট্টগ্রাম শহরে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। উভয় পানি শোধনাগারের পানি উৎস হালদা নদী। হালদা নদীতে লবণাক্ততার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় পানি উত্তোলন ও পরিশোধনপূর্বক পানি সরবরাহের পরিমাণ অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। হালদা নদীর লবণাক্ততার পরিমাণ কাপ্তাই ড্যাম হতে পানি ছাড়ার ওপর নির্ভরশীল। কর্ণফুলী নদীর পানি প্রবাহ কাপ্তাই ড্যাম হতে পানি নির্গমন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং শুষ্ক মৌসুমে কাপ্তাই ড্যাম হতে কর্ণফুলী নদীতে গড় পানি নির্গমন কম হলে হালদা নদীতে জোয়ারের সময় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়। ফলে কাপ্তাই ড্যাম হতে কর্ণফুলী নদীতে গড় পানি নির্গমন কম হলে লবণাক্ততা পরিহারের লক্ষ্যে জোয়ারের সময় মোহরা পানি শোধনাগার এবং শেখ রাসেল পানি শোধনাগারের পানি উৎপাদন হ্রাস করা হয়। ফলে চট্টগ্রাম মহানগরীর বেশ কিছু এলাকায় পানি সরবরাহ বিঘিœত হয়।’
এতে আরো বলা হয়, ২০২২ সালের ১৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহসহ চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রকৌশলীবৃন্দ কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিদর্শন করেন এবং রুল কার্ভ অনুযায়ী পানি ডিসচার্জের অনুরোধ করেন। কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, রুল কার্ভ অনুসারে লেকে পানি থাকার কথা ১০৯ ফুট, যা বর্তমানে আছে ৬৮ ফুট এবং একটি টারবাইন চালু আছে। পানির লেভেল না বাড়লে উক্ত ১টি টারবাইনও অল্প কিছুদিনের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ডিসচার্জ বন্ধ হয়ে গেলে লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি সরবরাহে বড় ধরনের বিঘœ ঘটবে। চট্টগ্রাম ওয়াসা ইতোমধ্যে রেশনিং পদ্ধতিতে পানি সরবরাহের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে।’
হালদা নদীতে লবণাক্ততা প্রবেশের ঝুঁকি হ্রাসে প্রতিবছর নভেম্বর হতে মে মাস পর্যন্ত কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কমপক্ষে দু’টি টারবাইন পরিচালনের অনুরোধ জানিয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসার পক্ষে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-এর চেয়ারম্যান বরাবরেও একটি পত্র দেয়া হয়।
এতে বলা হয়, কর্ণফুলী নদীর পানিপ্রবাহ কাপ্তাই ড্যাম হতে পানি নির্গমন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। শুষ্ক মৌসুমে ড্যাম হতে কর্ণফুলী নদীতে গড় পানি নির্গমন কম হলে কর্ণফুলী নদী এবং হালদা নদীতে জোয়ারের সময় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়। ফলে কাপ্তাই ড্যাম হতে কর্ণফুলী নদীতে গড় পানি নির্গমন কম হলে লবণাক্ততা পরিহারের লক্ষ্যে এই দুইটি ট্রিটমেন্ট প্লান্ট-এর পানি উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস করা হয় এবং চট্টগ্রাম মহানগরীতে পানি সরবরাহ বিঘিœত হয়।
বিগত বছরগুলিতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সার্বিক প্রচেষ্টায় শুষ্ক মৌসুমে কাপ্তাই ড্যাম নিয়ন্ত্রণ করে পানি ছাড়ার ফলে হালদা নদীতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম ও গ্রহণযোগ্য মাত্রায় ছিল।
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে ২০১৫ সালের নির্দেশনা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষকেও বছরের এ সময়ে একটি টারবাইন চালু রাখার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়।
ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ আজ বাসস’কে বলেন, ‘পানিতে লবণাক্ততা সমস্যার সমাধান ও নগরীতে পানি সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ওয়াসার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি, শিগগির বৃষ্টি হলে এ সমস্যা কমে যাবে। এছাড়া, সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সাথে সমন্বয় ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে আমরা স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজে পাবো। এজন্য চট্টগ্রাম ওয়াসা নিরলস কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।’
তিনি পানি ব্যবহারের ব্যাপারে নগরীর বাসিন্দাদের সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘ওয়াসার পানির অপচয় রোধে সকলকে সচেতন হতে হবে। এখনো আমরা নানাভাবে পানির অপচয় করে থাকি। ওয়াসার এ পানি আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের অপরিহার্য অনুসঙ্গ - শুধুমাত্র নগরবাসীর মাঝে এ বোধ তৈরি হলেই পানির অপচয় কমবে।’
এ ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য ওয়াসার পক্ষ থেকে লিফলেট, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়াসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তিনি জানান।