শিরোনাম
॥ মো. শফিকুল ইসলাম ॥
ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ১৫ মে, ২০২৩ (বাসস) : বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোস্তাব আলীর (৫৮) মৃত্যুর ঘটনায় তার স্ত্রী, একমাত্র ছেলে ও এক দাদন ব্যবসায়ি বিরুদ্ধে আত্মহত্যা প্ররোচণার অভিযোগে মামলা হয়েছে।
গত শনিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে অধ্যক্ষ মোস্তাব আলীর বড় ভাই মোহাম্মদ আলী বাদী হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানায় এই মামলাটি করেন। আর এই মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটনে মাঠে নেমেছে পুলিশ। পুলিশের দাবি, তাদের তদন্ত চলমান আছে।
দায়ের কারা মামলার আসামিরা হলেন অধ্যক্ষ মোস্তাব আলীর স্ত্রী নাটোর সদর উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামের বিলকিস খাতুন (৫০), অধ্যক্ষের ছেলে আহম্মেদ ওয়াজিহ ওয়াসিক (২৭) ও নাটোরের পাইকপাড়ার দাদন ব্যবসায়ি রায়েজুল ইসলাম ওরফে রাজু (৫৫)।
জানা যায়, অধ্যক্ষ মোস্তাব আলী নাটোরের পাইকপাড়ার মৃত মজির উদ্দিনের ছেলে। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শহরতুলির বিরাসারের বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের আওতাধীন বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শিরা জানান গত ১০ মে বুধবার সকাল নয়টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার ঘাটুরার ২ নম্বর লোকেশনের আবাসিক এলাকার বাস ভবন থেকে অধ্যক্ষ মোস্তাব আলীর লাশটি উদ্ধার করে সদর মডেল থানা পুলিশ। শৌচাগারের ভেতরে গলায় রশি প্যাঁচানো অবস্থায় লাশটি উদ্ধার করা হয়। পরদিন ১১ মে নাটোরের পাইকপাড়ায় তার লাশ দাফন করা হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানা থেকে প্রাপ্ত মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, দেড় থেকে দুই বছর আগে দাদন ব্যবসায়ি রায়েজুলের কাছ থেকে সুদের ওপর ৬ লাখ টাকা ঋণ নেন অধ্যক্ষ মোস্তাব আলী। সুদের কিস্তির টাকা নেওয়ার জন্য রায়েজুল প্রায়ই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অধ্যক্ষ মোস্তাব আলী কাছে আসা-যাওয়া করতেন। সুদের কিস্তি দিতে দেরি হলে তিনি মোস্তাব আলীকে অপমান অপদস্থ করতেন। এদিকে সাংসারিক বিভিন্ন বিষয়ে স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে মোস্তাব আলীর পারিবারিক কলহ চলছিল। তারা বিভিন্নভাবে মানসিক চাপ দিয়ে নাজেহাল করাসহ আত্মহত্যা করার জন্য মোস্তাব আলীকে উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলতেন। স্ত্রী-সন্তানের অপমানজনক কথাবার্তায় তিনি প্রায় সময় বাসায় সকালের নাশতা ও অনেক সময় দুপুরের খাবার খেতেন না। অধ্যক্ষ ঋণগ্রস্থ হওয়া সত্ত্বেও তার স্ত্রী-সন্তান বিলাসী জীবনযাপন করতেন। অধ্যক্ষ মোস্তাব আলীর ছেলে ওয়াসিক নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন করতেন। এ জন্য ওয়াসিক বিভিন্ন সময় টাকার জন্য অধ্যক্ষ মোস্তাব আলীকে চাপ দিতেন। প্রতিবাদ করলেই স্ত্রী-সন্তানের লাঞ্ছনার শিকার হতেন অধ্যক্ষ মোস্তাব আলী।
মামলার এজাহারে আরও বলা হয়েছে, ১০ মে বুধবার সকালে অধ্যক্ষ মোস্তাব আলী কাছে মুঠোফোনে সুদের টাকা চান রায়েজুল। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন মোস্তাব আলী। এই সময় স্ত্রী-সন্তানের অপমানজনক আচরণ আর পাওনাদারের কটূক্তিতে লজ্জা ও ঘৃণায় অধ্যক্ষ মোস্তাব আলী গলায় রশি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন।
অধ্যক্ষের স্বজনরা যা বলছেন: অধ্যক্ষ মোস্তাব আলী ভাতিজা একটি বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ বিন আলী বলেন, তার চাচা কলেজের অধ্যক্ষ থাকলেও পারিবারিকভাবে ভালো ছিলেন না। ঋণে জর্জরিত ছিলেন। কলেজের বেতনের সবটা দিয়ে প্রতি মাসে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতেন।
মামলার বাদী অধ্যক্ষের বড়ভাই মোহাম্মদ আলী বলেন, আমার ভাই আত্মহত্যা করার মতো মানুষ ছিলেন না। তার মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটন করার জন্য পুলিশের প্রতি অনুরোধ রইল। স্ত্রী-সন্তান তাকে মানসিক নির্যাতন করতেন। স্ত্রী-সন্তান ও পাওনাদার তার ভাইকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দিয়েছেন।
ঘটনার সময়ে অধ্যক্ষের সহকর্মীরা যা জানিয়েছেন: অধ্যক্ষ মোস্তাব আলীর গাড়ী চালক জয়নাল আবেদীন জানান ১০ মে বুধবার সকাল ৮টা ১২ মিনিটে তিনি অধ্যক্ষ স্যারকে মোবাইলে কল দিয়েছিলেন। তার সঙ্গে ১৭ মিনিট কথা হয়। মুঠোফোনে অধ্যক্ষ স্যার আমাকে ৯টার দিকে গাড়ি নিয়ে বাসার সামনে আসতে বলেন। বাসার নিরাপত্তা প্রহরী জিয়াউল হক জানান, সকাল সাড়ে আটটা থেকে পৌনে নয়টার দিকে অধ্যক্ষ স্যারের ছেলে ওয়াসিফ একটি শাবল নিয়ে আসতে বলেন। পরে আমি আর গাড়িচালক জয়নাল আবেদীন ও ছেলে ওয়াসিফ মিলে বাসার শৌচাগারের দরজা ভেঙে ঝরনার পাইপের সঙ্গে গলায় রশি প্যাঁচানো অবস্থায় অধ্যক্ষ স্যারকে দেখতে পাই। সেখান থেকে তাকে কক্ষের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। খবর পেয়ে চিকিৎসক ঘটনাস্থলে পৌঁছে অধ্যক্ষ স্যারকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে সদর থানা-পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে লাশটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
খুবই মেধাবি ছিলেন অধ্যক্ষ মোস্তাব আলী: বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোস্তাব আলী ছিলেন একজন খুবই মেধাবী। অল্প দিনে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারিদের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থান সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। আর অধ্যক্ষ হিসেবে প্রশাসনিক দক্ষতা ছিল খুবই প্রশংসনীয়। তবে তার মৃত্যু নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক ও কর্মচারি জানান, ছেলের ব্যবসার জন্য অধ্যক্ষ স্যার বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক টাকা ঋণ নিয়ে ছিলেন। ছেলেটা স্যারকে মানসিক নির্যাতন করতেন। তবে অধ্যক্ষ স্যার এই কথাগুলো তিনি কাউকে কখনও বলতেন না। শুধু নিরবে ভাবতেন আর প্রচুর ধূমপান করতেন।
তবে এই ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিটি মডেল কলেজের অধ্যক্ষ মোস্তাফা কামাল জানান, অধ্যক্ষ মোস্তাব আলী ছিলেন একজন অমায়িক ব্যক্তিত্ব। তিনি এই জেলার বাসিন্দা না হলেও এই জেলার শিক্ষা বিভাগের সাথে তার সু-গভীর সম্পর্ক ছিল। তার এই সময়ে চলে যাওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া শিক্ষা পরিবারের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে গেল। এই সময় তিনি তার মৃত্যুর বিষয়টি পুলিশী তদন্তের মাধ্যমে উদ্ঘাটন করার দাবি জানান।
মামলার আসামীরা যা বলছে: মামলার পর রোববার বিকেলে অধ্যক্ষ মোস্তাব আলীর ছেলে আহম্মেদ ওয়াজিহ ওয়াসিকের মোবাইল নাম্বারে যোগাযোগ করা হলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। তবে এর আগে ওয়াসিক বলেন, তার বাবা ব্যাংক থেকে ১৫ লাখ টাকা এবং কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ করেছিলেন। ঋণের কারণে তার বাবা আত্মহত্যা করেছেন বলে দাবি করেন তিনি।
অধ্যক্ষের স্ত্রী বিলকিস খাতুন জানান, আমার বাবার বাড়ির সম্পত্তি বিক্রি করে ছেলের ব্যবসার জন্য টাকা দিয়েছি। উনি (মোস্তাব আলী) টাকা পয়সা কী করতেন, কোথায় খরচ করতেন, আমরা জানতাম না। সবার সংসারে একটু না একটু সমস্যা থাকেই।
দাদন ব্যবসায়ি মোহাম্মদ রায়েজুল বলেন, ২১ মাস আগে ট্রাক ছাড়িয়ে আনার কথা বলে আমার কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা ধার নেন তিনি (অধ্যক্ষ মোস্তাব আলী)। সুদের ওপর টাকা দেওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়। আমি পাঁচবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গিয়েছি। তিনবার বাসায় ও দুবার কলেজে গিয়েছি।
ঘটনার দিন দাদন ব্যবসায়ি রাজু ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়: অধ্যক্ষ মোস্তাব আলী মৃত্যুর দিন ১০ মে বুধবার সকালে দাদন ব্যবসায়ি রায়েজুল ইসলাম ওরফে রাজু ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে এসেছিলেন অধ্যক্ষ মোস্তাব আলীর সাথে দেখা করতে। ধারণা করা হচ্ছে পাওনা টাকার জন্য তিনি এসেছিলেন। তার ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসার বিষয়টি নিশ্চিত করেন নিরাপত্তা প্রহরী জিয়াউল হক। মামলার বাদী অধ্যক্ষের বড় ভাই মোহাম্মদ আলী জানান ১০ মে বুধবার সকালে মুঠোফোনে সুদের টাকা চান রায়েজুল। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন অধ্যক্ষ মোস্তাব আলী। এই সময় স্ত্রী-সন্তানের অপমানজনক আচরণ আর পাওনাদারের কটূক্তিতে লজ্জা ও ঘৃণায় অধ্যক্ষ মোস্তাব আলী গলায় রশি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন।
পুলিশ যা বলছেন: মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. সাফায়েত উল্লাহ বলেন, মামলার তদন্ত শুরু করেছি। তবে প্রাথমিক তদন্তে যা জানা গেল, অধ্যক্ষ মোস্তাব আলী ঋণে জর্জরিত ছিলেন। পারিবারিক ভাবেও ভালো ছিলেন না। ঘটনার পর ঘটনাস্থল অধ্যক্ষের সরকারি বাসভবনে আমি একাধিকার গিয়েছি তদন্ত করার জন্য। পাশাপাশি আলামত সংগ্রহসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি গ্রহণ করেছি। তিনি জানান আসামীদের গ্রেপ্তারের অভিযানসহ তাদের ঘটনার আগে ও পরে ফোন কল পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ এমরানুল ইসলাম বলেন, অধ্যক্ষের মৃত্যুর ঘটনায় তার ভাই আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগ এনে মামলা করেছেন। এর আগে অধ্যক্ষের ছেলে থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করেছেন। পুলিশ এই বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এই ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাখাওয়াত হোসেন রোববার রাতে বাসসকে জানান- অধ্যক্ষকে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে গ্রহণ করা মামলাটি গভীরভাবে তদন্ত করবে পুলিশ। পাশাপাশি মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটনসহ আসামিদের গ্রেপ্তারের অভিযান অব্যাহত আছে বলে জানান তিনি।