শিরোনাম
ঢাকা, ২২ জুন ২০২৩ (বাসস) : দেশে বাল্যবিয়ে দেয়া পরিবারগুলোর মধ্যে নিম্নবিত্তের হার সবচেয়ে বেশি, আর মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর প্রায় এক চতুর্থাংশ বাল্যবিবাহ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ পরিচালিত এক সমীক্ষায় এ তথ্য উঠে এসেছে। আজ রাজধানীর ডেইলি স্টার ভবনের আজিমুর রহমান কনফারেন্স হলে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আয়োজিত ‘বাল্যবিয়ের কারণ ও সামাজিক অভিঘাত’ শীর্ষক সমীক্ষার প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়।
বাল্যবিবাহের এই হারকে অত্যন্ত উদ্বেগজনক উল্লেখ করে সমীক্ষায় বলা হয়, অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে সাথে অভিভাবকদের শিক্ষাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমীক্ষার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাল্যবিয়ে দেওয়া অভিভাবকদের মধ্যে প্রায় ৩১% (২৬০ জন) নিরক্ষর, ৪১% (৩৪৭ জন) অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন, ২৬% (২১৭জন) স্বল্প শিক্ষিত এবং শিক্ষিত ৪% (৩৩ জন)। সমীক্ষায় ৮টি বিভাগের ৩৭ টি জেলা এবং সিটি কর্পোরেশন, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, থানা এবং ইউনিয়ন পর্যায় থেকে ২০৬০ জনের নিকট হতে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মো: আব্দুল আজিজ, এমপি, গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী, বিআইজিডির প্রাকটিস অ্যান্ড হেড অব জেন্ডার অ্যান্ড সোশ্যাল ট্রান্সফরমেশন ক্লাস্টার এর সিনিয়র ফেলো মাহিন সুলতান, অ্যাম্বেসী অব সুইডেন-বাংলাদেশ এর সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার রেহানা খান, কেয়ার বাংলাদেশ-এর উইমেন এন্ড গার্লস এমপাওয়ারমেন্ট প্রোগ্রামের অ্যাক্টিং ডিরেক্টর রওনক জাহান এবং জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাসিমা আক্তার জলি। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু।
সমীক্ষার প্রেক্ষাপট আলোচনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম ও অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম। সমীক্ষার তথ্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের অ্যাডভোকেসি ও লবি পরিচালক জনা গোস্বামী ও আইনজীবী অ্যাড. ফাতেমা খাতুন।
এই জরীপে অংশগ্রহণকারী অভিভাবকদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৩-১৫ বছর বয়সী কন্যা শিশুরা বাল্যবিয়ের শিকার হয়, যা মোট বাল্যবিয়ের ৭২%। অন্যদিকে বাল্য বিয়ের শিকার ৫৭% কন্যাশিশুর বিয়ে ১২-১৫ বছরের মধ্যে হয়েছে। জরীপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৫৬% অভিভাবক বাল্যবিয়ের আইন সম্পর্কে অবগত হয়েও আইন অমান্য করে নানাভাবে তাদের কন্যাশিশুর বিয়ে দিয়েছেন। এ বিয়েগুলোর মধ্যে ৫৮% বিয়েই রেজিষ্ট্রি ছাড়া সম্পন্ন করা হয়েছে এবং বিয়ের সময় কাজীকে জন্মসনদ প্রদান করার কথা থাকলেও শতকরা ৫৪% অভিভাবক কাজীকে তার মেয়ের জন্মসনদ প্রদান করেননি। জরিপকালে ৩৬% ম্যারেজ রেজিষ্ট্রার জানিয়েছেন, সমাজে বাল্য বিয়ের হার মাত্র ১০%। মাত্র ৩% ম্যারেজ রেজিষ্ট্রার বলেছেন, দেশে বাল্য বিয়ের হার ৫০%।
সমীক্ষায় বাল্যবিয়ের কারণ হিসেবে নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক গৎবাধা দৃষ্টিভঙ্গীকে (যেমন: কন্যা সন্তানকে বোঝা মনে করা, বিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে কন্যার প্রতি দায়িত্ব পালন ইত্যাদি) চিহ্নিত করা হয়েছে। আর এর ফলাফল আরো ভয়াবহ। যা অভিভাবক, নারী এবং সর্বোপরি সমাজকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। যেমন, বাল্যবিয়ের ফলে কন্যাশিশুর উপর আসা অভিঘাত সারজীবন বয়ে বেড়ানো, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়া, নারীর স্বাস্থ্য অধিকার ক্ষুণœ এবং জীবনভর নির্যাতনের শিকার হতে থাকা ইত্যাদি।
মো: আব্দুল আজিজ, এমপি, বলেন, গ্রামে হতদরিদ্রদের মধ্যে বাল্যবিয়ের প্রবণতা বেশি। তাই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে দেশে অনেক আইন থাকা সত্বেও সামাজিক বাস্তবতার কারণে অনেক সময়ই তা প্রয়োগ করা সম্ভব হয়না। এসব আইনের কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের আরো তৎপর হতে হবে। তিনি বাল্যবিবাহ বন্ধে কিশোরী ক্লাবগুলোর মাধ্যমে কিশোরীদের সচেতন করাসহ কিশোর-কিশোরী, জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাকে সমন্বিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানান।
রাশেদা কে চৌধুরী বাল্যবিয়ের প্রবণতায় জেলাভিত্তিক কোন পার্থক্য আছে কিনা, এটা মূল রিপোর্টে আনার পরামর্শ দেন। তিনি ‘পালিয়ে বিয়ে করায় বাল্যবিয়ে বাড়ছে’- জনপ্রতিনিধিদের এমন অজুহাত বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেন, বাল্যবিয়ের শাস্তি হিসেবে উপবৃত্তি বন্ধ করাসহ সামাজিক বিভিন্ন শর্ত আরোপ করা যেতে পারে। তিনি এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে সমন্বয় করে কিশোরী ক্লাব মনিটরিং করার আহ্বান জানান।
ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বড় বাধা। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কিশোরীরা যে ভূমিকা পালন করছে, তা অত্যন্ত সীমিত। শিক্ষার মান উন্নত করার সাথে সাথে শিক্ষাকে পণ্য হওয়া থেকে মুক্ত করে কিশোর কিশোরীদের মানবিক শিক্ষা দেয়ার ওপর তিনি জোর দেন। তিনি বলেন, নারীর ক্ষমতায়নের সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণও সমাজে জোরালো ভূমিকা পালন করে। তাই রাজনীতিতে, সম্পদ-সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার এবং নারীর অবৈতনিক গৃহশ্রম বন্ধ করার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি বাল্যবিয়ে বন্ধে বহমান সংস্কৃতি, দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রথার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে জনপ্রতিনিধিসহ সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান।