শিরোনাম
॥ মলয় কুমার দত্ত ॥
ঢাকা, ৩০ জুন, ২০২৩ (বাসস) : আশ্রয়ণ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই আবাসন প্রকল্পটি দেশকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্তত আটটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়তা করছে।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গৃহহীন জনগোষ্ঠীর জন্য প্রবৃদ্ধি ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নতুন মাত্রার সূচনা করেছেন- 'কেউ পিছে পয়ে থাকবে না'।
আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের সিনিয়র সহকারী সচিব মোঃ সায়েদুল আরেফিন বাসসকে বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে, সরকার গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য বিনামূল্যে জমি বরাদ্দ করছে এবং বাড়ি নির্মাণ করছে এবং তাদের আয়বর্ধক কার্যক্রমে নিযয়োজিত করে স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করছে।
তিনি বলেন, এই উদ্যোগের মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের শুধু জমি ও বাসস্থান প্রদানই নয়, খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক চাহিদা প্রদানের মাধ্যমে উন্নয়নের পথে তাদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করছে।
সুবিধাভোগী নির্বাচনে অতি দরিদ্র, ভিক্ষুক, বিধবা, বয়স্ক মানুষ, স্বামী পরিত্যক্তা নারী, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা, জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত, বিশেষ সম্প্রদায় , যেমন তৃতীয় লিঙ্গ, দলিত, হরিজন সম্প্রদায়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, শারীরিক প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
মান্ডু মিয়া (৩৫) নন্দনপুর গ্রামে একটি টিনের ঘরে মা ও তিন ভাইকে নিয়ে থাকতেন। তিনি হিজড়া সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ায় স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পাননি।
মান্ডু মিয়া বলেন, “আমি জীবিকা নির্বাহের তাগিদে অর্থ উপার্জনের জন্য বিয়েসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচ-গান করতাম।”
তার জীবন ছিল দুর্ভোগ ও অপমানের। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার খাটিহাটা আশ্রয়ণ প্রকল্পে আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের আওতায় আধাপাকা ঘরসহ দুই শতাংশ জমি উপহার পেয়ে বর্তমানে পরিবারসহ সেখানে বসবাস করছেন। ঢাকা সিলেট মহাসড়ক সংলগ্ন এই সম্পত্তির বাজার মূল্য প্রায় ছয় লক্ষ টাকা। মান্ডু মিয়া, যাকে অন্যের ভাড়া বাড়িতে থাকতে হয়েছিল, এখন একটি স্থায়ী ঠিকানা এবং একটি উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ পেয়েছে।
তিনি তার কিছু সঞ্চয় এবং হাঁস-মুরগি পালন করে প্রকল্পের পাশে একটি মুদি দোকানের মালিক হয়েছিলেন। সেই দোকানের আয় দিয়ে তিনি মোট ৩,০০,০০০ টাকায় কিস্তিতে একটি সিএনজি কিনেছেন।
গীতা রানী দাস (৩২) স্বামী বাবলু দাস (৪০) সন্তানদের নিয়ে খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার একটি বস্তিতে ভাড়া বাসায় থাকতেন। কষ্টের দিনগুলোতে তারা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারেনি।
২০২১ সালে, গীতা রানী মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া অমূল্য উপহার হিসেবে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার কাঁঠালতলা আশ্রয়ণ প্রকল্পে দুই ডেসিমেল জমিতে তৈরি একটি আধা-পাকা বাড়ি পান।
"এটা আমার কল্পনার বাইরে ছিল যে আমার নিজের একটি বাড়ি হবে। আমি এখন খুব খুশি কারণ আমি জমিসহ একটি বাড়ি পেয়েছি," তিনি বলেন।
তার স্বামী বাবলু দাস এখন বেতের ঝুড়ি, ডাল ও খাঁচা তৈরি করে কাঁঠালতলা বাজারে বিক্রি করেন।
গীতা রানী গৃহস্থালির কাজ করার পাশাপাশি স্বামীর কাজে সহযোগিতা করেন। স্বামীর আয় এবং নিজের কাজ থেকে যা আয় হয় তা তাদের জন্য যথেষ্ট। ছেলে মেয়েরা এখন পাশের স্কুলে পড়েছে।
প্রকল্পের বিবরণে বলা হয়েছে, ‘আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় সরকার শুধুমাত্র মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রায় ২,৩৭,৮৩১ ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে বিনামূল্যে আবাসন নিশ্চিত করেছে।
প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত সারাদেশে মোট ৫,৫৫,৬১৭ ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
এর মধ্যে ১ লাখ ৬০ হাজার ৫৭৩ পরিবারকে ব্যারাক হাউসের মাধ্যমে, ১,৫৩,৮৫৩ পরিবারকে মালিকানাধীন জমিতে বাড়ি নির্মাণ করে পুনর্বাসন করা হয়েছে।কক্সবাজার জেলার খুরুশকুল ইউনিয়নে বহুতল ভবনে বিনামূল্যে ফ্ল্যাটে ৬৪০ টি জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার এবং বিশেষভাবে তৈরি ঘরের মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ৬০০ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ১০০ পরিবার ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত ১০০০ পরিবারকেও পুনর্বাসন করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ৪০০ বর্গফুট আধা-পাকা দুই কক্ষ বিশিষ্ট সিঙ্গেল-ইউনিট বাড়ি তৈরীর কার্যক্রম চালু করা হয়। বাড়িগুলির সামনে একটি দীর্ঘ বারান্দা, একটি রান্নাঘর এবং পিছনে একটি স্যানিটারি ল্যাট্রিন রয়েছে৷ বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সংযোগ ছাড়াও নিরাপদ পানীয়ের সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে।
আশ্রয়ণ’ নিছক একটি আবাসন প্রকল্পের চেয়েও একটি বৃহত্তর এবং বিস্তৃত ধারণা। ভূমিহীন-গৃহহীন সুবিধাভোগীদের প্রত্যেকে একটি সু-পরিকল্পিত টেকসই ঘর সহ দুই শতাংশ জমির মালিকানা পায়। ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের ভূমিহীন পরিচয় ত্যাগ করছে। কাউকে ভূমিহীন-গৃহহীন না রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুসরণ করে, প্রকল্পটি সম্প্রতি ৫২টি উপজেলা (উপজেলা) এবং ২টি জেলাকে ভূমিহীন-গৃহহীন মুক্ত করেছে।
বাংলাদেশের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য বিমোচনের কারণ হল অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের নীতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার কর্তৃক গৃহীত অন্যান্য উদ্যোগ। বঙ্গবন্ধু কন্যা অতি-দরিদ্র ভিক্ষুক, বিধবা, নিঃস্ব নারী এবং ভূমিহীন-গৃহহীনদের জন্য জমি বরাদ্দ ও বাড়ি নির্মাণের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় এনেছেন, যা সম্পদের আরও সুসম বণ্টনের দিকে একটি বড় পদক্ষেপ। অন্যান্য অনগ্রসর জনগোষ্ঠী, যেমন জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ , ভিক্ষুক, দলিত, হরিজনদেরও এই প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে।
এটি একটি অনন্য এবং বিশ্বের বৃহত্তম উদ্যোগগুলির মধ্যে একটি যার লক্ষ্য বিনা মূল্যে বাড়ি প্রদানের মাধ্যমে দুর্বল এবং অনগ্রসর গোষ্ঠীগুলিকে মূল স্রোতে অন্তর্ভুক্ত করা। বন্দবাড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্পে কুষ্ঠ রোগীদের পুনর্বাসন করেছে, যারা অস্পৃশ্য বলে বিবেচিত হয়।
এছাড়া তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও জাতিগত রাখাইন সম্প্রদায়ের নিঃস্বদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে ঘরবাড়ি।
দিনাজপুরের পার্বতীপুরের কয়লাখনি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার, হরিজন সম্প্রদায়, ভিক্ষুকসহ পিছিয়ে পড়া সকল মানুষকে উন্নয়নের মূলধারায় আনা হচ্ছে। পুনর্বাসনের পাশাপাশি প্রকল্পটি এই সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি করছে।