বাসস
  ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৩৫

জনবল সংকটে কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা সেবা ব্যাহত

লালমনিরহাট, ৪ জানুয়ারি, ২০২৫(বাসস) : আধুনিক যন্ত্রপাতি, চিকিৎসক ও জনবল সংকট নিয়েই দীর্ঘদিন ধরে চলছে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কার্যক্রম। ফলে রোগীদের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ঘুরে দেখা গেছে এমন দৃশ্য।

 উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতেই ৩১ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে রোগীদের দুর্ভোগ কমাতে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল হিসেবে উন্নীতকরণ করা হলেও সেবার মান এখনো সন্তোষজনক নয় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের ।

হাসপাতালের রোগী ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় নানান সংকটের মধ্য দিয়ে চলছে এ হাসপাতালের কার্যক্রম।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, লালমনিরহাটের অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর মতোই এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পুরুষ রোগী থেকে নারী রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন অনেক মুমূর্ষু রোগী। অপরদিকে জনবল সংকটে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হচ্ছে।

রোগী অনুপাতে চিকিৎসক স্বল্পতা, ওষুধ সংকট ও খাবার সরবরাহে তেমন সন্তোষজনক সেবা পাচ্ছেন না চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনেরা। এছাড়াও সুইপার সংকটের কারনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ময়লা আবর্জনা। রোগীদের অভিযোগ, রোগ নির্ণয়ের আধুনিক যন্ত্রপাতি তেমন না থাকায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বাইরের ক্লিনিকে তাদেরকে যেতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে রোগীদের আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা।

জানা গেছে, চিকিৎসকসহ নিম্ন জনবল সংকটে চালানো হচ্ছে  হাসপাতালের নিয়মিত কার্যক্রম।  উন্নত স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার সামান্য কিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও ওষুধ থাকলেও সেসবের সুবিধা তেমন পান না রোগীরা। নেই দক্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা নিরীক্ষা করার ল্যাব-টেকনিশিয়ান। এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসেন শত শত অসুস্থ মানুষ।

কালীগঞ্জের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক,কর্মকর্তা,কর্মচারীদের মঞ্জুরীকৃত পদের সংখ্যা মোট ১১০টি, কর্মরত পদে রয়েছে  ৭৬ জন ও (শুন্য) পদের সংখ্যা ৩৪টি। গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসক (শুন্য) পদগুলো হলো : জুনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারী), জুনিয়র কনসালটেন্ট (শিশু), জুনিয়র কনসালটেন্ট (কার্ডিঞ্জ), জুনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (চর্ম ও যৌন), জুনিয়র কনসালটেন্ট (চক্ষু), ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার,আবাসিক মেডিকেল অফিসার,এ্যানেসথেসিস্ট ও হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল অফিসার ।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের যন্ত্রের সংখ্যা ও ধরণ :  এক্স-রে মেশিন (ডিজিটাল) সংখ্যা : ১টি , যন্ত্র: ত্রুটিপূর্ণ ,মেরামত যোগ্য। এক্স-রে মেশিন (অ্যানালগ) সংখ্যা : ১টি , যন্ত্র : অচল। এনেসথেসিয়া মেশিন সংখ্যা : ২টি, যন্ত্র : সচল ১টি, অচল ১টি। ডেন্টাল এন্ড এক্সসেসর সংখ্যা : ১টি, যন্ত্র : সচল। ডায়াথার্মি সংখ্যা: ২টি, যন্ত্র: সচল ১টি,অচল ১টি। ওটি লাইট সংখ্যা : ২টি, যন্ত্র : সচল। অপারেশন লাইট ৪ বাল্ব সংখ্যা : ১ টি, যন্ত্র : সচল। ও টি টেবিল সংখ্যা : ২টি, যন্ত্র : সচল ১টি, অচল ১টি। ও টি স্পর্ট লাইট সংখ্যা : ১টি, যন্ত্র :  অচল। ও টি এয়ারকন্ডিশনার সংখ্যা : ১টি, যন্ত্র : সচল। আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন ১টি, যন্ত্র : অচল। ডেলিভারি টেবিল সংখ্যা : ২টি, যন্ত্র : সচল। ইসিজি মেশিন সংখ্যা : ৬টি, যন্ত্র : সচল ১টি, অচল ৫টি। অক্সিজেন কনসেটেটর সংখ্যা : ৪টি, যন্ত্র : সচল ৩টি, অচল ১টি।

সেন্টিফিউজ মেশিন ৬ হোল্ড সংখ্যা : ২টি, যন্ত্র : সচল । সেমি অটোমেটিক ইলেকট্রিক এনালাইজার ২টি, যন্ত্র : সচল ১টি, অচল ১টি। ব্লাড ব্যাংক রেফ্রিজেটর সংখ্যা : ১টি, যন্ত্র : অচল । বাইনোকুলার মাইক্রোস্কপ সংখ্যা : ৪টি, যন্ত্র : সচল ১টি, অচল ৩টি। জেনারেটর মেশিন সংখ্যা : ১টি, যন্ত্র : সচল । অ্যাম্বুলেন্স সংখ্যা : ২টি, যন্ত্র : সচল ১টি, অচল ১টি।  উল্লেখ্য যে, এসব যন্ত্রপাতির আংশিক কিছু অচল ।

চিকিৎসা নিতে আসা উপজেলার চন্দ্রপুর ইউনিয়নের আব্দুল কাদের (৫০) বলেন, জ্বর, পেটে ব্যথা ও বুকে ব্যথাসহ বেশ কিছুদিন ধরেই রোগে ভুগছি। এখানে আসার পর ডাক্তার কয়েকটি টেস্ট দিল। সেই টেস্টের প্রায় সবগুলোই বাইরে থেকে করে নিয়ে আসতে হবে। যদি বাহিরে থেকেই করে নিয়ে আসতে হয় তাহলে এখানে এসে  কী লাভ হলো?

চলবলা ইউনিয়নের নিলিমা আক্তার (৩৮) বলেন, আমার এক বছরের মেয়েকে  ভর্তি করিয়েছি। বেড না পাওয়ায় বারান্দার মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছি। ঠাণ্ডার কারনে চিকিৎসা নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। অনেকগুলো ওষুধ লিখে দিয়েছে ডাক্তার। লিখে দেওয়া সেই ওষুধগুলো এখানে না পেয়ে বেশি দামে বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে।

মেয়ের ঠান্ডাজনিত রোগের চিকিৎসা নিতে আসা উপজেলার মদাতী ইউনিয়নের আফজাল হোসেন (৪৪) বলেন,  হাসপাতালে আমি দুইদিন থেকে রয়েছি। এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের খাবারের মান তেমন বেশি সুবিধাজনক নয়। সেই সাথে প্রয়োজনীয় তেমন ওষুধও পাওয়া যায় না। দুই একটি ওষুধ পাওয়া গেলেও বাকি ওষুধ প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী বাইরের ফার্মেসি থেকে নিয়ে এসে মেয়েকে খাওয়াতে হচ্ছে।

মেয়ের চিকিৎসার জন্য আসা আফসানা বেগম (৪০) বলেন, এ হাসপাতালে  অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে গতকাল থেকে আছি। হাসপাতালে পরিবেশ তেমন ভালো না। খাবারের মান সুবিধাজনক নয়। ওষুধের কথা তো নাই বলি। একজন রোগীর পর্যাপ্ত সেবা এখানে মেলে না।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কয়েকজন কর্মচারী ও স্থানীয়রা জানায়, বর্তমানে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের খাবারের মান তেমন ভালো না। সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় ওষুধও তেমনভাবে মেলে না। এখানে ভর্তি হওয়া রোগীরা রাতে যদি আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে দেখার মতো ডাক্তার  মেলে না। এখানে ডিজিটাল এক্সরে মেশিন, ইসিজি, অপারেশন থিয়েটারসহ সব ধরনের আংশিক ব্যবস্থা থাকলেও টেকনিশিয়ান ও দক্ষ জনবলের অভাবে এগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই সাধারণ কিছু চেকআপও বাইরে থেকে করে নিয়ে আসতে হচ্ছে। এছাড়া জরুরী বিভাগ, অভ্যন্তরীণ চিকিৎসা প্রদান, আউটডোর ও অ্যাম্বুলেন্স সেবায় নেই পর্যাপ্ত লোকবল। এক প্রকার নাজুক অবস্থা এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের।

কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ তৌহিদ হাসান বাসস’কে বলেন, চিকিৎসকসহ নিম্ন জনবল সংকটে চলছে আমাদের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিয়মিত কার্যক্রম। এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসেন শত শত মানুষ। রোগী অনুপাতে চিকিৎসক স্বল্পতা ও ওষুধ সংকট রয়েছে এখানে। সেই সঙ্গে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্য ল্যাব টেকনিশিয়ানের অভাব। বর্তমানে এখানকার খাবারের মান যথেষ্ট ভালো করার চেষ্টা করে যাচ্ছি আমরা। এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের  বর্তমানে অন্যতম সমস্যা হলো সুইপার সংকট যার কারনে ময়লা আবর্জনা পরিষ্কারে  একটু সমস্যা হচ্ছে। এ সমস্যাগুলো সমাধান হলে স্বাস্থ্য সেবার মান আরো ভালো হবে এমনটাই আশা প্রকাশ করেন তিনি।

কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ আলী রাজিব মোঃ নাসের বাসস’কে বলেন, লোকবল সঙ্কটেও আন্তরিকতার  সঙ্গে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। বর্তমানে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক ও জনবল সংকটের মধ্য দিয়েই পরিচালিত হচ্ছে। ভালো সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের কর্তৃপক্ষের ও চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে। জনবলের চাহিদাসহ আরো বেশ কিছু সমস্যা সমাধানের জন্য আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আশা করি সাময়িক সমস্যাগুলো খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ হবে এবং সুচিকিৎসা নিশ্চিত হবে।