শিরোনাম
।। জাহিদুল খান সৌরভ ।।
শেরপুর, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : হারিয়ে যাচ্ছে শেরপুরের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর সাতটি সম্প্রদায়ের নিজস্ব মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি। পারিবারিক চর্চা কমে যাওয়া ও নিজস্ব ভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ না থাকায় সময়ের সাথে বিলুপ্তি হওয়ার পথে এ ঐতিহ্য। এমন অবস্থায় ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় একটি কালচারাল একাডেমি ও নিজস্ব ভাষার পাঠ্যবইয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন অনেকে।
শেরপুর জেলার শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার বিশাল অংশজুড়ে গারো পাহাড় অবস্থিত। যেখানে গারো, কোচ, হাজং, বানাই, ডালুসহ সাতটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ৫০ হাজারের বেশি মানুষের বসবাস। যেখানে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা 'আদিবাসী উন্নয়ন প্রকল্পের' তথ্যমতে, জেলায় গারো ১৬ হাজার ৫০০, হাজং ৪ হাজার ৭০০, হদি ১০ হাজার ৬০০, বর্মণ ১৭ হাজার, কোচ সাড়ে তিন হাজার, ডালু ১ হাজার ১০০, বানাই ১১০ জন রয়েছেন। এ মানুষগুলোর রয়েছে নিজস্ব ভাষা। তাদের পরিবারের সুখ-দুঃখের গল্পটা চলে নিজ মাতৃভাষাতেই। কিন্তু ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনতে হাঁটতে হয় বাংলা ভাষার হাল ধরে। তাই দিন দিন নিজ মাতৃভাষা হারিয়ে যাওয়ায় আক্ষেপে তারা।
গারো ও কোচ ভাষা কোনোমতে টিকে থাকলেও অন্য ভাষা হাঁটছে বিলুপ্তির পথে। প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় নিজস্ব বর্ণপরিচয়, চর্চা ও লেখাপড়ার সুযোগ না থাকায় এমন অবস্থা বলে মনে করেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকেরা । কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষার বই থাকলেও শিক্ষক না থাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বইগুলো পড়ানো যাচ্ছে না। ফলে শিকড় থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে এসব জাতিগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ উত্তরসূরিরা।
হদি সম্প্রদায়ের প্রিয়ন্তি বিশ্বাস (১৪) বলেন, নিজেদের মধ্যে ভাষার চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব আমাদের ভাষা বিলুপ্তির অন্যতম মূল কারণ। আমরা নতুন প্রজন্মের শিশুরা শিক্ষিত হচ্ছে আধুনিক শিক্ষায়। আর অল্প কিছু স্কুলে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা ধরে রাখার চেষ্টা করা হলেও ভাষাভিত্তিক শিক্ষক সংকট দীর্ঘদিনের।
শিক্ষার্থী সুবল বর্মন (২৬) বলেন, আমরা জাতিতে বর্মন। আমাদের বাবা দাদারা একসময়ে বর্মন ভাষায় কথা বললেও আমরা বর্মন ভাষায় কথা বলতে পারি না। আমাদের নিজস্ব ভাষার বই সরকার চালু না করলে আমাদের ভাষাটা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
রাকেশ কোচ (২৪) বলেন, আমরা পরিবারের সদস্যরা কোচ ভাষায় কথা বলি। কিন্তু স্কুলে তো আমাদের ভাষায় পড়ার কোন ব্যবস্থা নাই। তাই আমাদের দাবি ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় একটি কালচারাল একাডেমি ও নিজস্ব ভাষার পাঠ্যবইয়ের।
শেরপুরের আদিবাসী উন্নয়ন সংস্থা আইইডি'র (ফেলো) সুমন্ত বর্মণ জানান, আধুনিক ভাষার আগ্রাসন ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আদিবাসী শিশুরা তাদের সংস্কৃতি, ভাষা ও ঐতিহ্য ধরে রাখার যথেষ্ট উৎসাহ বোধ করে না।
সমস্যার কথা স্বীকার করে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ওবায়দুল্লাহ বলেন, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের ভাষা থাকলেও তাদের কোনো পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষক নেই। তবে, সরকারের পক্ষ থেকে উপজাতিদের ভাষাভিত্তিক শিক্ষক তৈরির প্রচেষ্টা চলমান আছে বলে জানান তিনি।
শেরপুর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হাফিজা জেসমিন বাসস'কে জানান, জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস একটি চিঠি পাঠানো হয়েছিল। ২০২৩ সালে শেরপুরে এ এথনিক সার্ভেটি সম্পন্ন হয়েছে এবং এর ফাইনাল রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এটি পরবর্তী কর্মসূচি প্রণয়নে ভালো একটি ভূমিকা রাখবে।