শিরোনাম
॥ মাহমুদুল হাসান রাজু, মলয় কুমার দত্ত ও বাদল নুর ॥
ঢাকা, ২০ আগস্ট, ২০২৩ (বাসস) : আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের তৎকালীন সভাপতি আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম ১৯ বছর আগে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় শরীরের বিভিন্ন স্থানে স্পিøন্টারের আঘাতের কারণে সৃষ্ট যন্ত্রণা এখনো সহ্য করছেন। কীভাবে এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল তা স্মরণ করে তিনি বলেন, ২০০৪ সালে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট শাসনামলে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ হামলা চালানো হয়।
অনুষ্ঠানের জন্য একটি ট্রাক ব্যবহার করে একটি অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করা হয়। বিকাল ৫টায় মঞ্চে আসেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা এবং বিকাল ৫টা ২ মিনিটে তিনি ভাষণ শুরু করেন। তিনি একটি টানা ২০ মিনিট বক্তৃতা করেন। তিনি ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে তার বক্তব্য শেষ করার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দক্ষিণ দিক থেকে প্রথম গ্রেনেডটি নিক্ষেপ করা হয়। এরপর শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে, দক্ষিণ দিক থেকে একের পর এক মোট ১৩টি কুখ্যাত আর্জেস গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম বলেন, ‘আক্রমণে আমি গুরুতর আহত হই এবং তিন দিন অজ্ঞান ছিলাম। দেশে-বিদেশে চিকিৎসা নিয়েছি। এখনো যন্ত্রণা সহ্য করছি।’
হামলায় গুরুতর আহত হন ঢাকা উত্তর মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শাহেদা খানম দীপ্তি। তার অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে হামলার পর প্রথমে তাকে স্থানীয় হাসপাতালে মৃত ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে ঢাকা উত্তর শহর মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দীপ্তি বলেন, ‘আমি পরের সাত দিন অজ্ঞান ছিলাম। পরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারত ও সিঙ্গাপুরে পাঠান। আমি ভারতের পিয়ারলেস হাসপাতাল ও বেলভিউ হাসপাতালে চিকিৎসা নেই। অসংখ্য স্পিøন্টারের কারণে সৃষ্ট ক্ষত ঢেকে কিছুটা স্বাভাবিক দেখাতে আমাকে স্কিন গ্রাফটিং করাতে হয়। পরের ছয় মাস আমি শয্যাশায়ী ছিলাম।’ তিনি বলেন, ‘এখনও আমি কী কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তা প্রকাশ করার ভাষা নেই। এখনও মাঝে মাঝে আমার অসহ্য যন্ত্রণা, চুলকানি ও মাথাব্যথা হয়। আমার দলের অনেক কর্মী এ বর্বর হামলার কারণে একই যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গেছে।’
দীপ্তি তার ও অন্য আহতদের দেখাশোনা এবং তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
সাংবাদিক ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী আশরাফুল আলম খোকনও ওই দিন তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে স্পিøন্টারের আঘাতের কারণে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা ভুগছেন। ভয়ঙ্কর ঘটনাটি স্মরণ করে তিনি বলেন, সে সময় তিনি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের সাংবাদিক ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধু এভিনিউ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ কভার করছিলাম। সেখানে একটি ট্রাক ব্যবহার করে একটি অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করা হয়। খোকন জানান, সংসদে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সামনে তিনি অস্থায়ী মঞ্চের নীচে মাইক্রোফোন হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপ-প্রেস সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করা খোকন বলেন, ‘যখন প্রথম গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হয়, তখনও তিনি তার বক্তব্য শেষ করতে পারেননি। প্রথম বোমা ছোড়া হলে আমি আহত হই। তবে এটি প্রধান টার্গেট শেখ হাসিনাকে মিস করে।’ তিনি তার সহকর্মী এবং অন্যরা যাকে পরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে বাঁচিয়ে তুলেন- তাদের কথা উল্লেখ করে বলেন, কিছু লোক তাকে নিকটবর্তী সরকার পরিচালিত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়, যেখানে হামলায় গুরুতর আহত অসংখ্য লোককে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু ডাক্তাররা সেখানে তাদের চিকিৎসা দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের কিছু স্টাফ আমাকে মৃত ভেবে লাশের স্তূপে রেখে দেয়। পরে, আমার অফিসের সহকর্মীরা আমাকে সেখানে জীবিত দেখতে পেয়ে আমাকে বেসরকারি হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নিয়ে যায়। আঘাত থেকে সেরে ওঠার পর, আমি জানতে পারি যে হাসপাতাল প্রথমে আমাকে চিকিৎসা দিতে চায়নি এবং চিকিৎসা না দিয়ে আমাকে জরুরি বিভাগে ফেলে রাখে।’ এরপর, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার অ্যাটেন্ড্যান্টদের জানায় যে হামলায় আহত কোনো ব্যক্তিকে সেখানে ভর্তির অনুমতি না দেওয়ার জন্য তাদের কাছে সরকারের ‘উচ্চ পর্যায়ের’ নির্দেশ ছিল। তিনি বলেন, চ্যানেল আইয়ের উচ্চপদস্থরা পরে তাকে সেখানে ভর্তি করাতে সক্ষম হন। সেখানে চিকিৎসা নেওয়ার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনি ব্যাংককে যান। এরপর থেকে এখনও তাকে আঘাতের জন্য চিকিৎসা নিতে হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটি আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।’
হামলার সময় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এনামুল হক শামীম শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর জখম হয়। গ্রেনেডের ২০-২২টি স্পিøন্টারের আঘাতে সৃষ্ট যন্ত্রণা তিনি এখনও বহন করছেন। কীভাবে ঘটনাটি ঘটেছিল তা স্মরণ করে তিনি বলেন, মঞ্চ লক্ষ্য করে একের পর এক গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। এরপর দলীয় নেতাকর্মীরা তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রক্ষায় মানব ঢাল গঠন করেন। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা সেদিন জঘন্য গ্রেনেড হামলায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। গ্রেনেড হামলায় বেঁচে যাওয়ায় শেখ হাসিনাকে ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার সময় তার গাড়িতে কয়েক ডজন গুলি লাগে।
বঙ্গবন্ধু কন্যাকে বহনকারী গাড়িটি বুলেটগ্রুফ হওয়ায় গুলি ঢুকতে পারেনি। হামলার পরপরই শেখ হাসিনাকে একটি গাড়িতে করে ধানমন্ডিতে তার তৎকালীন বাসভবন সুধা সদনে নিয়ে যাওয়া হয়।
আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও বর্তমান পানিসম্পদ উপমন্ত্রী শামীম আদালতের রায় কার্যকর করতে তারেক রহমানসহ পলাতক সব আসামিকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
আ. লীগের তৎকালীন উপ-কমিটির নেতা এস এম কামাল হোসেন বলেন, প্রচ- আঘাত পেয়ে আমি রাস্তায় পড়ে থাকি। প্রথমে আমাকে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তৎকালীন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে চিকিৎসকরা চিকিৎসা না দেওয়ায়, আমাকে পরে ধানমন্ডির একটি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে আমার অপারেশন করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ভারতে পাঠান আওয়ামী লীগ সভাপতি। আ .লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হোসেন বলেন, ‘এই জঘন্য হামলায় অনেক মানুষ পঙ্গু হয়ে গেছে এবং অনেকে মৃত্যু বরণ করেছে। আমি সকল দোষী ব্যক্তির ফাঁসির রায় কার্যকর করার দাবি জানাচ্ছি।’
ওই হামলায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ মোট ২৪ জন নিহত এবং আরও ৫ শতাধিক আহত হন এবং অনেকেই আজীবন পঙ্গুত্ববরণ করেন।