শিরোনাম
॥ আনিসুর রহমান ॥
ঢাকা, ২১ অক্টোবর, ২০২৩ (বাসস): পশ্চিমা সহায়তায় ইসরাইল রাষ্ট্রটি সৃষ্টির প্রায় দু’দশক আগেই নোবেলজয়ী বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আশঙ্কা করেছিলেন যে ফিলিস্তিনি আরবদের কোণঠাসা করার জায়নবাদী প্রচেষ্টা ‘পবিত্র ভূমি’তে ‘কুৎসিত বিস্ফোরণ’ ঘটাবে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষবার আমেরিকা সফরের সময় জ্যুইস স্ট্যান্ডার্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ আশঙ্ক ব্যক্ত করেন।
পত্রিকাটির ১৯৩০ সালের ২৮ নভেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত এ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘যদি জায়নবাদী নেতৃত্ব ফিলিস্তিনে ইহুদিদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ আরবদের থেকে আলাদা করার ওপর জোর দেয়, তাহলে পবিত্র ভূমিতে কুৎসিত বিস্ফোরণ ঘটবে।’
রবীন্দ্রনাথ অবশ্য ইহুদিদের আবাসভূমির জন্য প্রচারণার সরাসরি বিরোধিতা করেননি এই প্রত্যাশা করে যে এটি ইহুদিদের ফিলিস্তিনি আরবদের সাথে তাদের যৌথ প্রচেষ্টা এবং অনন্য গুণাবলীর সমন্বয়ে সাধারণ কল্যাণের জন্য পুনরায় একত্রিত করবে।
তবে নোবেলজয়ী কবি তখনকার ইহুদি অভিযানের ফলাফল সম্পর্কে তার আশঙ্কা প্র্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি। তিনি বলেছেন, ‘তবে, এখন আপনাদের রাজনৈতিক দীক্ষা আপনাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক অন্ধ গলিতে, একটি লক্ষ্যহীন পথে।’
তিনি ইহুদি সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনি কি একই সাথে ইহুদি ও ফিলিস্তিনি হতে পারেন না?’
সাক্ষাৎকার গ্রহীতা উল্লেখ করেন যে ঠাকুরের মুখে এসময় ‘প্রায় অলৌকিক প্রশান্তি’ নেমে আসে।
তিনি পিছনে হেলান দিয়ে বসেন এবং তার নিজের কথার প্রতিধ্বনি শুনেন।’
রবীন্দ্রনাথ তখন যোগ করেন, ‘ফিলিস্তিনে আরব-ইহুদি সম্প্রীতি অর্জন করতে হবে।’
সাক্ষাৎকার গ্রহীতা জিজ্ঞাসা করেন, ‘এই সম্প্রীতি কীভাবে অর্জন করা যায়?’ এ প্রশ্নের উত্তরে বাঙালি কবি ক্লান্তভাবে বলেন, ‘আমি রাষ্ট্রনায়ক নই, আপনার প্রশ্নের উত্তর জানার ভানও করছি না।’
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর দৃষ্টিতে দার্শনিক কবি রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘(কিন্তু) আমি আরবদের চিনি, এবং আমি বিশ্বাস করি যে আমি ইহুদিদেরও চিনি এবং সেই কারণেই আমি মনে করি যে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা অর্জন করা যেতে পারে।’
তিনি ইহুদিদের সম্পর্কে তার উপলব্ধি বর্ণনা করে বলেন, তারা একটি প্রচীন জনগোষ্ঠী, যারা নিপীড়ন, নির্যাতন সহ্য করেছে এবং তারা কোনোমতেই তাদের পরিচয় হারায়নি। আর তাদের সংস্কৃতি ও ধর্মে তাদের শক্তি নিহিত।
রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আরবরাও একটি সহনশীল জাতি। তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি ইহুদিদের মতো একই ছাঁচ থেকে এসেছে। আধ্যাত্মিকভাবে আরবরা ইহুদিদের কাছ থেকে অনেক কিছু ধার করেছে। মৌলিকভাবে দেখা যায়, আপনারা ও তারা একই পরিবার-হ্যাঁ, একটি মহান পরিবার।’
সাক্ষাৎকারকারী উল্লেখ করেন যে মুখে হাসি নিয়ে ‘দার্শনিক’ কবি এরপর মন্তব্য করেন ‘পারিবারিক ঝগড়া সবসময়ই মারাত্মক, তবে সেগুলো মিটমাট করা যায়।’
রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আপনারা (ইহুদি) আরবদের থেকে অনেক বেশি দূরের, সবদিক থেকে যারা আপনাদের কাছে বিদেশি মানুষের মধ্যে থাকতে শিখেছেন। এমনকি যান্ত্রিক সংস্কৃতির দেশ আমেরিকাতেও আপনারা ইহুদি ও আমেরিকান উভয়ই হতে পেরেছেন।’
রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আমি একটি ফিলিস্তিন কমনওয়েলথ কল্পনা করি যেখানে আরবরা তাদের নিজস্ব ধর্মীয় জীবনযাপন করবে এবং ইহুদিরা তাদের উজ্জ্বল সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করবে, তবে উভয়ই এক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সত্তা হিসাবে একত্রিত হবে।’
রবীন্দ্রনাথ তার সাক্ষাৎকার গ্রহীতাকে বলেন যে তিনি দেখতে পাচ্ছেন ‘আপনার চোখে সংশয় রয়েছে এবং আপনি মনে করছেন এটি একজন ‘সরল’ কবির প্রগলভতা।
তিনি ফিলিস্তিনে ‘কুৎসিত অগ্ন্যুৎপাত’ এড়াতে আরব-ইহুদি সম্প্রীতির জন্য তার আবেদনকে দৃশ্যত জোরদার করে বলেছেন, ‘আপনি ভাবছেন এটা কিভাবে করা যায়। আমি ইহুদি জনগোষ্ঠীর সামর্থ্য এবং বিশেষ মেধা নিয়ে সন্দেহ করি না।’
এই সাক্ষাৎকার প্রকাশের ১৮ বছর পরে ইসরায়েলকে একটি ইহুদিবাদী দেশ হিসাবে নামকরণ করা হয়।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে ইহুদিরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে স্বতন্ত্র সম্প্রদায় হিসেবে বসবাস করার সময় তাদের ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের সন্ধান শুরু করে। তখন রবীন্দ্রনাথ সাক্ষাৎকারে তাঁর চিন্তাভাবনা ব্যক্ত করেন।
‘জায়নবাদ’ শব্দটি তখন দৃশ্যত তার বর্তমান আকারে একটি নির্মম আগ্রাসী শব্দ হিসাবে আবির্ভূত হয়নি, রবীন্দ্রনাথ যার বিরোধী ছিলেন।
তাই, যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে তিনি ‘জায়নপন্থী কি না, তখন কবি বলেন যে তিনি এ আদর্শকে ‘সম্মান করেন’ তবে একই সাথে এ বিশ্বাসের অনুসারীদের একই সাথে ইহুদি ও ফিলিস্তিনি হওয়ার আহ্বান জানান।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী যুক্তি দিয়ে বলেন, ‘কিন্তু শ্রদ্ধেয় ঠাকুর, ইহুদিবাদ ইহুদিদের (বিভিন্ন দেশে) এই দ্বৈত জীবন থেকে পালানোর চেষ্টা করছে। এটি তাদের জন্য উদ্দিষ্ট যারা অন্য জাতির সাথে আত্তীকরণ করতে পারে না বা করতে চায় না।’
জিয়্যুস স্ট্যান্ডার্ড-এর সাংবাদিক জোর দেন, আপনার পরামর্শ অনুসারে যদি ইহুদিদের ইহুদি জাতীয়তাবাদ ও ফিলিস্তিনিবাদের মধ্যে পার্থক্য করতে হয়, তাহলে ইহুদিদের ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনি কেবলমাত্র অন্য আমেরিকা, ফ্রান্স বা জার্মানি হবে।
সাক্ষাৎকারকারী উল্লেখ করেন যে ‘ছন্দময় কণ্ঠে- যা তার কথোপকথনেও একটি কাব্যিক স্বাদ দেয়- রবীন্দ্রনাথ উত্তর দেন যে তিনি ইহুদিবাদকে ‘আমার মহান বন্ধু আইনস্টাইনের মতো একই অর্থে’ বোঝেন।
তিনি বলেন, ‘আমি ইহুদি জাতীয়তাবাদকে ইহুদি সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য রক্ষা ও সমৃদ্ধ করার প্রচেষ্টা হিসাবে বিবেচনা করি। ‘যদি ইহুদিরা তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে আরবদের অন্তর্ভুক্ত করে’ তবে ফিলিস্তিন এটি নিশ্চিত করতে পারে।
রবীন্দ্রনাথ বলেন, আপনাদের (ইহুদি) আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচির এই রাজনৈতিক সহযোগিতা পাওয়ার জন্য কিছু ত্যাগ করার দরকার নেই।’
কবি বলেন যে তিনি একটি ফিলিস্তিন কমনওয়েলথ কল্পনা করেন যেখানে আরবরা তাদের নিজস্ব ধর্ম জীবনযাপন করবে এবং ইহুদিরা তাদের উজ্জ্বল সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করবে, ‘কিন্তু উভয়ই এক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সত্তা হিসাবে একত্রিত হবে’।
আপনি যদি আরবদের বোঝাতে পারেন যে তাদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ আপনার সাথে অভিন্ন, যদি আপনি তাদের দেখান যে ফিলিস্তিনে আপনার কাজ দ্বারা আপনি আপনার সাংস্কৃতিক পার্থক্যকে বিবেচনা না করে আরব ও ইহুদিদের জন্য সমানভাবে গড়ে তুলছেন, তাহলে সময়ের সাথে সাথে আরবরা আপনার সবচেয়ে বিশ্বস্ত মিত্র হয়ে উঠবে।’
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর মতে, তিনি নম্রভাবে বলার চেষ্টা করেন যে জায়নবাদীরা সাম্প্রতিক অতীতে রবীন্দ্রনাথ যা পরামর্শ দিচ্ছেন তা চেষ্টা করেছিল কিন্তু তবুও তাদের আক্রমণ করা হয়েছিল (১৯২৯ সালে জেরুজালেমের ওয়েলিং ওয়ালের ইহুদিদের ব্যবহার নিয়ে বিরোধের কারণে)। ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাকে বাক্যটি শেষ করতে দেননি। তার সুন্দর মুখের ওপর একটা ছায়া ভেসে উঠল: ‘ওসব কুৎসিত ঘটনার কথা এখন বলবেন না। যা ঘটেছে তার কারণেই আমি আমার মতো করে কথা বলি।’
বাঙালি কবি তখন বলেন যে তখন পর্যন্ত ইহুদিদের থেকে ভিন্ন হলেও আরব জাতীয়তাবাদ ছিল প্রাথমিকভাবে আধ্যাত্মিক। আর কয়েক শতাব্দী ধরে আরবরা তাদের ভূমিকে অবহেলা করেছে, কারণ আধ্যাত্মিকভাবে তারা ছিল রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদের ঊর্ধেŸ।
রবীন্দ্রনাথ ইহুদিদেরকে আরবদের ভীতি উপলব্ধি করতে বলেন যে ইহুদিদের আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার জন্য ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণের নিবিড়ভাবে জড়ো করার ফলে তাদের আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, আমি বোঝানোর চেষ্টা করছি যে ইহুদিদের আবাসভূমিতে আরবদের মনস্তাত্ত্বিক সমন্বয় অবশ্যই একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া হতে হবে।
রবীন্দ্রনাথ বলেন, কিছু ছোটখাটো মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তিনি মৌলিকভাবে আইনস্টাইনের ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত যা ‘ক্ষুদ্র নৈরাজ্যবাদের, অনমনীয় রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদের’ বিরোধী এবং এটি বরং ‘আপনাকে সেই বিস্তৃত জাতীয়তাবাদের দিকে নিয়ে যাবে যা আপনি ফিলিস্তিনে সমগ্র মানবতার জন্য একটি উদাহরণ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।’
আপনার সহ-ফিলিস্তিনিদের কাছে মুক্ত মনে আসুন এবং তাদের বলুন: ‘আপনারা এবং আমরা উভয়ই পুরানো জাতি। আমরা দুজনেই অদম্য জাতি। আপনারা আমাদের বশীভূত করতে পারবেন না, এবং আমরাও আপনাদের বদলানোর চেষ্টা করব না। কিন্তু আমরা দু’জাতিই নিজেদের হতে পারি, নিজেদের পরিচয় ধরে রাখতে পারি এবং এখনও ফিলিস্তিন, ইহুদি ও আরবদের কমনওয়েলথের রাজনৈতিক লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি।
রবীন্দ্রনাথের প্রত্যাশার পরিনতি কি হয়েছিল সমসাময়িক ইতিহাস থেকে তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।