শিরোনাম
॥ মলয় কুমার দত্ত ও জাহিদ হোসেন ॥
খুলনা, ১২ নভেম্বর, ২০২৩ (বাসস) : সুন্দর রূপসা নদীর তীরে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় খুলনা শহরের মানুষ আগামীকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আগামীকাল তিনি সেখানে একটি জনসভায় ভাষণ দেবেন এবং ২৯টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। বহু প্রত্যাশিত পদ্মা সেতুর মাধ্যমে খুলনা ২০২২ সালে সরাসরি রাজধানী ঢাকার সাথে সড়ক পথে যুক্ত হয়েছে।
জনগণের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা বঙ্গবন্ধুকন্যা তাদের দীর্ঘদিনের লালিত কিছু স্বপ্ন পূরণ করবেন এই আশায় পুরো খুলনা অঞ্চলে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। তারা আশা করছেন আগের মতোই প্রধানমন্ত্রী বিমানবন্দর, গ্যাস সরবরাহ শুরু করা, অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং জেলায় পাট ও কাগজের মিল সহ সমস্ত বন্ধ রাষ্ট্র পরিচালিত কারখানা এবং মিলগুলি পুনরায় চালু করবেন।
বাংলাদেশের সাদা সোনা চিংড়ি চাষের জন্য বিখ্যাত এই পরিচ্ছন্ন নগরী খুলনাকে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাতে ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড ও পোস্টারে সাজানো হয়েছে ।
খুলনাকে সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান এবং বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল সুন্দরবনের পাশাপাশি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং ব্যস্ততম সমুদ্রবন্দর বাগেরহাট জেলার মংলা উপজেলায় অবস্থিত, যা সম্প্রতি ৬৫ কিলোমিটার রেল সংযোগের মাধ্যমে খুলনার সাথে সংযুক্ত হয়েছে।
২ নভেম্বর থেকে যশোর, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, কুষ্টিয়া জেলার পোড়াদহ জংশন, কুষ্টিয়া শহর, রাজবাড়ীর কালুখালী, গোপালগঞ্জের ভাটিয়া পাড়া ও ফরিদপুরের ভাঙ্গা হয়ে খুলনার সাথে রাজধানী ঢাকার সাথে খুলনার সংযোগকারী বাণিজ্যিক ট্রেন চলাচলের সময় দুই ঘণ্টা কমতে শুরু করে। এখন ৭ ঘণ্টা ১৫ মিনিটের মধ্যে খুলনা থেকে ঢাকায় পৌঁছানো যায়।
তবে ভাঙ্গা থেকে যশোর হয়ে গোপালগঞ্জ ও নড়াইল পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে থাকায় আগামীতে খুলনায় যেতে যাত্রীদের রাজবাড়ী জেলা অতিক্রম করতে হবে না।
আগামী বছরের জুনের মধ্যে এটি চালু হওয়ার কথা রয়েছে। এটি রাজধানী এবং দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পাশাপাশি ভারতের শহর কলকাতার মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে দেবে।
খুলনার বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলায় ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ১৮৩৪ একর জমির উপর নির্মিত হয়েছে।
খুলনা ইউনেস্কোর আরেকটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান খুলনা শহর থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে বাগেরহাটে অবস্থিত ষাট গম্বুজ মসজিদসহ অনেক প্রাচীন স্থাপত্যের সৌন্দর্যের জন্যও বিখ্যাত।
এটি সুলতানি আমল (১৩৫২-১৫৭৬) থেকে বাংলাদেশের বৃহত্তম মসজিদ। এটি সালতানাতের সময় সুন্দরবনের গভর্নর খান জাহান আলী নির্মাণ করেছিলেন। এটিকে ‘সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক মুসলিম স্মৃতিস্তম্ভগুলোর মধ্যে একটি’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
আগামী জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খুলনা সফর এ অঞ্চলের মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি খুলনা সার্কিট হাউস গ্রাউন্ডে আয়োজিত একটি বিশাল জনসভায় ভাষণ দেবেন। সেখানে তিনি পূর্বে ৩ মার্চ, ২০১৮-এ পাঁচ বছর আগে একটি সমাবেশে ভাষণ দিয়েছিলেন।
তিনি ২৪টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন এবং ১০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাঠামোসহ আরও পাঁচটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন।
তিনি খুলনা বিভাগের সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় যোগ দেবেন বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সাধারণ) পুলক কুমার মন্ডল।
আওয়ামী লীগের খুলনা মহানগর শাখার সভাপতি ও সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক বলেছেন, সকল স্তরের মানুষ তাদের ‘ভাগ্য নির্মাতা’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কারণ দশ লাখের বেশি লোকের সমাবেশে এটিকে মানব সাগরে পরিণত করার আশা করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসক খোন্দকার ইয়াসির আরেফিন বাসসকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সফর উপলক্ষে পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।
বাসস খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি কাজী আমিনুল হকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সফরে খুলনার জনগণ খুবই খুশি পাশাপাশি তাদের স্বপ্ন পূরণের দাবি রয়েছে তার কাছে।
দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে অবিলম্বে খুলনা বিমানবন্দর নির্মাণের কাজ শুরু করা, খুলনা-মংলা ভাঙ্গা সড়ককে চার লেনে উন্নীত করা, রূপসা, তেরখাদা ও দিঘলিয়াকে খুলনা শহরের সঙ্গে সংযোগের জন্য টানেল নির্মাণ, মংলা বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। যদিও অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং অব্যাহত ড্রেজিং ব্যবস্থা, খুলনার পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ শুরু করা, যশোর-খুলনা মহাসড়ককে ছয় লেনে উন্নীত করা, খুলনায় অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়ন, পৃথক ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, আমদানি-রপ্তানি সহজ করতে মংলা বন্দরের কাছে কনটেইনার স্টেশন স্থাপন, পাট ও কাগজের কল সহ বন্ধ সকল কল-কারখানা পুনরায় চালু করা, সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা, নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে রূপসা, ভৈরব ও পশুর নদীতে নিয়মিত ড্রেজিং নিশ্চিত করা, বাংলাদেশ টেলিভিশনের সম্পূর্ণ কেন্দ্র চালু করা, বোটানিক্যাল গার্ডেন ও চিড়িয়াখানা নির্মাণ। মেরিন একাডেমি ও ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠা, খুলনা আলিয়া মাদ্রাসা ও মহিলা আলিয়া মাদ্রাসা জাতীয়করণ, আহসানউল্লাহ কলেজ, হাজী আবদুল মালেক কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, দৌলতপুর দিবা নিশি কলেজ, খুলনা থেকে যশোর হয়ে দর্শনা পর্যন্ত ডাবল রেললাইন নির্মাণ, ঢাকার সাথে দূরত্ব কমানোর জন্য খুলনা-গোপালগঞ্জ রেলপথ নির্মাণ। কালনা সেতু হয়ে ঢাকা-খুলনা রেল কানেকটিভিটি বাস্তবায়ন।
এলজিইডির খুলনা জেলা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) এই সময়ের মধ্যে গত ১৫ বছরে নয়টি উপজেলায় ৪,০২১.১ কোটি টাকা ব্যয়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করায় সমগ্র খুলনা জেলায় ব্যাপক উন্নয়ন দেখেছে।
২০০৯-২০২৩ অর্থবছরে সমাপ্ত প্রকল্পগুলো হল ১,৯০৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ২,৫০২ কিলোমিটার রাস্তা এবং ৭০৪ কিলোমিটার সড়ক সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণে ৫৯৭ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
এ সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা অন্যান্য প্রকল্পগুলো হলো- ৮৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০৭টি সেতু ও কালভার্ট, ৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭টি উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স নির্মাণ, ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮টি উপজেলা সার্ভার স্টেশন নির্মাণ, ৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৩টি ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স, ৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪২টি হাট-বাজার-ঘাট ও গ্রোথ সেন্টার, ১৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮৩টি সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণ, ১৫১ কোটি টাকায় ৫০৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ ও ক্লাসরুম সম্প্রসারণ।
গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮ হাজার ৪৫০ একর জমিতে পানিসম্পদ উন্নয়ন, ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬৫ কিলোমিটার খাল খনন, ০.৭১ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৬টি রেগুলেটর রক্ষণাবেক্ষণ, ৩.৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ।
৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট ১০টি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ২৪টি বাসভবন নির্মাণ এবং ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭টি ঐতিহাসিক স্থান, জাদুঘর ও মুক্তিযুদ্ধের ৬টি মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিসৌধ রক্ষণাবেক্ষণ।
এছাড়া ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে শহর ও ইউনিয়নে মোট ২২টি ভূমি অফিস নির্মাণ করা হয়েছে।
১ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে জেলা শিল্পকলা একাডেমি ভবন ও মুক্তমঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে।
৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে মসজিদ, মন্দির, শ্মশানসহ মোট ১৭৫টি ধর্মীয় স্থাপনা।
এর বাইরে ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৯টি পুকুর ও খাল খনন, ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিস সেন্টার এবং ৯৬ কোটি টাকা ব্যয়ে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ করা হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে খুলনা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী এ কে এম আনিসুজ্জামান বাসসকে বলেন, চলতি অর্থবছরে ৬৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় ২০টি চলমান প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।