শিরোনাম
ঢাকা, ৭ অক্টোবর, ২০২৪ (বাসস) : ইসরাইলের চেয়ে সামরিক শক্তিতে তিন ধাপ এগিয়ে ইরান। সামরিক সক্ষমতায় শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে র্যাংঙ্কিংয়ে ইরানের অবস্থান ১৪, আর ইসরাইলের অবস্থান ১৭তম। পারমাণবিক স্থাপনা, সামরিক খাতে ব্যয়, সেনাদের সদস্য সংখ্যা সবকিছুতেই দখলদারদের টক্কর দিকে প্রস্তুত তেহরান। তবু কেন তেল আবিবের এত দাপট? ওয়াশিংটন থেকে এএফপি জানায়।
গত ১ অক্টোবর মঙ্গলবার স্থানীয় সময় রাতে ইসরাইলি ভূ-খ-ে অন্তত ২শ’টি ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা চালায় ইরান। দেশটির তিনটি সামরিক ঘাঁটি ও বেশকিছু অবকাঠামো লক্ষ্য করে এ অভিযান চালানো হয়।
ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী ‘আইআরজিসি’ জানায়, গাজায় দখলদারদের চলমান হত্যাকা- এবং হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া, হিজবুল্লাহ প্রধান নাসরুল্লাহর হত্যার জবাবে এই হামলা চালায়। নেতানিয়াহু বলেছেন, ইসরাইলে একসাথে ২শ’ ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা চালিয়ে ‘মারাত্মক ভুল করেছে এবং এই জন্য তেহরানকে ‘চড়া মূল্য’ দিতে হবে। তিনি এই হামলার প্রতিবাদে পাল্টা প্রতিশোধ নেয়ারও হুমকি দেন।
এক প্রতিবেদনে বিবিসি জানায়, ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে সরাসরি সংঘাত ঘিরে একটি আঞ্চলিক
যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা করছেন অনেকে। কারণ, দুটি দেশই সামরিক দিক থেকে বেশ শক্তিশালী। সে তালিকায় শীর্ষ ২০টি দেশের মধ্যে ইরানের অবস্থান ১৪ আর ইসরাইলের অবস্থান ১৭তম।
গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইরান সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে ইসরাইলের
তুলনায় তিন ধাপ এগিয়ে। এই অবস্থায় দুই দেশের সামরিক সক্ষমতা, একে অপরকে আক্রমণ ও নিজ
ভূ-খ- রক্ষার সামর্থ্য কতটুকু এসব বিষয় খতিয়ে দেখেছে কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আলজাজিরা। প্রশ্ন ওঠেছে ইসরাইলের চেয়ে সামরিক শক্তিতে তিনধাপ এগিয়ে ইরান, তবু কেন এত দাপট নেতানিয়াহু প্রশাসনের?
যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্যট্রেজিক স্টাডিজ এর মিলিটারি ব্যালান্স ২০২৩ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরানের সামরিক বাহিনীর সক্রিয় সদসসংখ্যা ৬ লাখ ১০ হাজার।
এর মধ্যে ৩ লাখ ৫০ হাজার সেনাসদস্য, ১ লাখ ৯০ হাজার বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর সদস্য, ১৮ হাজার
নৌসেনা, ৩৭ হাজার বিমানসেনা ও ১৫ হাজার বিমানপ্রতিরক্ষা সদস্য। দেশটির রয়েছে ৩ লাখ ৫০
হাজার রিজার্ভ সেনাও।
ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর সক্রিয় সদস্যসংখ্যা ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫শ’। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর
সদস্য ১ লাখ ২৬ হাজার, নৌসেনা ৯ হাজার ৫শ’ এবং বিমানবাহিনীর সদস্য ৩৪ হাজার। দেশটির রয়েছে ৪ লাখ ৬৫ হাজার রিজার্ভ সেনাও। গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গত এপ্রিল মাসের তথ্যমতে, ইরান ২০২৩ সালে সামরিক খাতে ব্যয় করেছে ১০ দশমিক ৩ বিলিয়ন, অর্থাৎ ১ হাজার
৩০ কোটি ডলার। ২০২২ সালের তুলনায় এটি ০ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি।
একই সময়ে ইসরাইলের ব্যয় ছিল ২৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন, অর্থাৎ ২ হাজার ৭৫০ কোটি ডলার। এটি
২০২২ সালের তুলনায় ২৪ শতাংশ বেশি। গত বছরের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের গাজায় শুরু করা নজিরবিহীন হামলার কারণে দেশটির ব্যয় এক বছরে এত বেড়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
দ্য মিলিটারি ব্যালান্স ২০২৩ অনুযায়ী, ইরানের রয়েছে ১০ হাজার ৫১৩টি ট্যাংক, ৬ হাজার ৭৯৮টি
কামান এবং ৬৪০টির বেশি সাঁজোয়া যান। এই ছাড়া সেনাবাহিনীর রয়েছে ৫০টি হেলিকপ্টার, বিপ্লবী
গার্ড বাহিনীর রয়েছে আরও ৫টি। বিপরীতে ইসরাইলের রয়েছে প্রায় ৪শ’ ট্যাংক, ৫৩০টি কামান ও ১
হাজার ১৯০টি সাঁজোয়া যান।
দ্য মিলিটারি ব্যালান্স ২০২৩ অনুযায়ী, ইরানের বিমান বাহিনীর রয়েছে ৩১২টি যুদ্ধবিমান, বিপ্লবী
গার্ডের রয়েছে আরও ২৩টি। বিমানবাহিনীর রয়েছে ২টি জঙ্গি হেলিকপ্টার, সেনাবাহিনীর রয়েছে ৫০টি
এবং বিপ্লবী গার্ডের ৫টি। আর ইসরাইলের রয়েছে ৩৪৫টি যুদ্ধবিমান ও ৪৩টি জঙ্গি হেলিকপ্টার।
দ্য মিলিটারি ব্যালান্স ২০২৩ অনুযায়ী, ইরানের রয়েছে ১৭টি সাবমেরিন, ৬৮টি প্যাট্রল ও কোস্টাল কমব্যাটান্ট, ৭টি রণতরি, ১২টি ল্যান্ডিং শিপ, ১১টি ল্যান্ডিং র্ক্যাফট, ১৮টি লজিস্টিকস ও সাপোর্ট সরঞ্জাম। অন্যদিকে ইসরাইলের রয়েছে ৫টি সাবমেরিন ও ৪৯টি প্যাট্রোল ও কোস্টাল দ্য মিলিটারি ব্যালান্স ২০২৩ অনুযায়ী, ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মূলত নির্ভরশীল আয়রন ডোম’–ব্যবস্থার ওপর। মঙ্গলবার রাতে ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের অধিকাংশই আয়রন ডোম– ব্যবস্থায় প্রতিহত করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
একেকটি আয়রন ডোম–ব্যবস্থায় থাকে একটি রাডার, যা সম্ভাব্য আঘাত হানা ক্ষেপণাস্ত্র বা অন্য বস্তুর গতি ও লক্ষ্যস্থল শনাক্ত করে।
পরে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ নিসেব নিকাশ করে দেখে, এটি কোনো হুমকি না হলে ওই ক্ষেপণাস্ত্র বা বস্তুকে ফাঁকা স্থানে পড়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। আর হুমকি মনে হলে সেটি ভূপাতিত করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্দিষ্ট ইউনিট থেকে ছোঁড়া হয় ক্ষেপণাস্ত্র।
ইসরাইল জুড়ে আছে ১০টি আয়রন ডোম ব্যাটারি। আছে আরও কিছু প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, যার সাহায্যেও মধ্যম ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত হানা প্রতিহত করা হয়।
এদিকে ইরান গত ফেব্রুয়ারিতে স্বল্পপাল্লার আজারখশ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করেছে। এটি একটি ইনফ্রারেড শনাক্ত করণ ব্যবস্থা। সম্ভাব্য আঘাত হানা ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত ও তা প্রতিহত করতে এ ব্যবস্থায় যুক্ত আছে রাডার এবং ইলেক্ট্রো– অপটিক ব্যবস্থা। এটি যানবাহনের ওপরও স্থাপন করা যায়।
ইরানের আছে বিভিন্ন পাল্লার ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এর মধ্যে আছে ৪২টির বেশ দূরপাল্লার রাশিয়ার তৈরি এস-২০০ ও এস-৩০০
এবং ৫৯টির বেশি মাঝারি পাল্লার যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এমআইএম-২৩ হক, এইচকিউ-২জে ও খোরদাদ-১৪। আছে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্যাট্রেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মিসাইল ডিফেন্স প্রজেক্টের দেয়া তথ্য অনুসারে, ইরানের অস্ত্র ভান্ডারে রয়েছে অন্তত ১২ ধরনের মধ্যম ও স্বল্প পাল্লার ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এগুলোর একটি টনডার-৬৯, এর পাল্লা ১৫০ কিলোমিটার। এছাড়া আছে খোরামশাহর ও সেজিল। এগুলোর পাল্লা ২ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত।
অপর দিকে ইসরাইলের রয়েছে অন্তত চার ধরনের স্বল্প ও মধ্যম এবং মধ্যবর্তী পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এর মধ্যে এলওআরএ ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ২৮০ কিলোমিটার ও জেরিকো-৩ ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ৪ হাজার ৮শ’ কিলোমিটার থেকে ৬ হাজার ৫শ’কিলোমিটার।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ইসরাইলের আনুমানিক ৯০টি পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র রয়েছে। এদিকে ধারণা করা হচ্ছে, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র নেই। তবে তার রয়েছে খুবই সমৃদ্ধ পরমাণু কর্মসূচি। দেশটি বেশ কিছু পরমাণু স্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্র পরিচালনা করছে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি পরমাণু অস্ত্রের উৎপাদন নিষিদ্ধ করে ২০০০ সালের শুরুতে একটি ফতোয়া দেন।
তিনি বলেছিলেন এই ধরনের কর্মকা- নিষিদ্ধ।’ অবশ্য ইসরাইলের আগ্রাসন ও বৈশ্বিক হুমকি বিবেচনায় গত মে মাসে তেহরান তার অস্তিত্ব রক্ষায় পরমাণু কর্মসুচিতে পরিবর্তন আনার হুমকি দিয়েছে।