বাসস
  ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ২০:৩২
আপডেট : ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩:০৯

মার্চের মধ্যে ‘বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো’ কার্যকর হবে: লুৎফে সিদ্দিকী

প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশেষ দূত অধ্যাপক লুৎফে সিদ্দিকী। ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত অধ্যাপক লুৎফে সিদ্দিকী আজ বলেছেন, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের আমদানি ও রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য মার্চ মাসের মধ্যে ‘বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো’ কার্যকর হবে।

তিনি বলেন, ‘১৯টি সার্টিফিকেট, লাইসেন্স ও পারমিট (সিএলপি) প্রদানকারী সংস্থার মধ্যে সাতটি এই ধাপে অন্তর্ভুক্ত। আমরা ২০২৫ সালের ৩১ জানুয়ারি থেকে সাতটি সংস্থার ম্যানুয়াল সিস্টেম বন্ধ করে দেব। ৩১ জানুয়ারির পর সাতটি সরকারি সংস্থার জন্য ম্যান্যুয়াল সিএলপি জমা আর গ্রহণ করা হবে না।’

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) ‘শ্বেতপত্র এবং অতঃপর  অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, সংস্কার ও জাতীয় বাজেট’ শীর্ষক সিম্পোজিয়ামে ‘অর্থনৈতিক সংস্কার ও প্রতিষ্ঠান’ শীর্ষক দ্বিতীয় অধিবেশনে সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে বিশেষ দূত একথা বলেন।

এই সাতটি সংস্থা হলো ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর (ডিজিডিএ), রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি), বিস্ফোরক অধিদপ্তর (ডিওইএক্স), বাংলাদেশ জাতীয় কর্তৃপক্ষ, রাসায়নিক অস্ত্র কনভেনশন (বিএনএসিডব্লিউসি), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) ও পরিবেশ অধিদপ্তর (ডিওই)। 

লুৎফী সিদ্দিকী বলেন, বাকি ১২টি সংস্থা ফেব্রুয়ারির মধ্যে এই উইন্ডোতে একীভূত হবে।

তিনি বলেন, তবে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকরা তাদের ব্যবসায়িক পরিচয় নম্বর (বিআইএন) ব্যবহার করে প্ল্যাটফর্মে নিবন্ধন করতে পারবেন এবং প্রয়োজনীয় সমস্ত নথি ডিজিটালি জমা দিতে পারবেন।

তিনি বলেন, এই সিস্টেম ব্যবহার করে একজন আমদানিকারক বা রপ্তানিকারক সমস্ত সার্টিফিকেট, লাইসেন্স ও পারমিট পেতে পারবেন এবং পণ্য ছাড়পত্রের জন্য একটি একক অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রয়োজনীয় তথ্য জমা দিতে পারবেন।

‘শ্বেতপত্র ২০২৪-এর চেয়ার, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)’র বিশিষ্ট ফেলো ও সিটিজেন প্ল্যাটফর্ম ফর এসডিজিএস-এর আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য অধিবেশনটি সঞ্চলনা করেন।

শ্বেতপত্রের লেখক ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (আইইউবি)’র উপাচার্য এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর অধ্যাপক ড. ম. তামিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং শরণার্থী ও অভিবাসী আন্দোলন গবেষণা ইউনিট (আরএমএমআরইউ)’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ড. তাসনিম আরেফা সিদ্দিকী, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)’র বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (এসএএসইএম) এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান শ্বেতপত্রের ওপর উপস্থাপনা করেন।

বিশিষ্ট ভাষ্যকার হিসেবে বক্তব্য দেন সিপিডি’র বিশিষ্ট ফেলো প্রফেসর রওনক জাহান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এবং তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ, বিদ্যুৎ ও বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’র সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ, বাংলাদেশের ইউরোপীয় ইউনিয়নের উন্নয়ন সহযোগিতা প্রতিনিধিদলের প্রধান ড. মাইকেল ক্রেজ্জা, বিশ্বব্যাংকের মানব উন্নয়ন বিভাগের প্রধান অর্থনীতিবিদ ও প্রোগ্রাম লিডার সাইদ আমের আহমেদ এবং জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও অতিরিক্ত মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বছরে প্রায় ১৬.০ বিলিয়ন ডলার অর্থ পাচার হয়েছে বলে আনুমানিক হিসাব করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বিদেশে কর অবকাশ অঞ্চলে বিনিয়োগ, জমি, বাড়ি ও ফ্ল্যাট ক্রয় এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করার মতো বহু স্তরে অবৈধ অর্থ পাচার হয়েছে এবং তা গোপন করা হয়েছে। 

তিনি বলেন, অবৈধ অর্থপাচার মোকাবেলায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও রাজনৈতিক চাপ, শক্তিশালী স্বার্থান্বেষী মহলের পরিকল্পিত হস্তক্ষেপ এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আন্তরিক উদ্যোগের অভাবের কারণে এর বেশিরভাগই কার্যকর হয়নি।

তবে মোস্তাফিজুর রহমান আদালতে মামলা দায়ের, ফরেনসিক তদন্ত এবং আইন বিশেষজ্ঞ ও সম্পদ পুনরুদ্ধারে বিশ্বব্যাখ্যাত বিশেষজ্ঞ সংস্থাগুলোকে নিয়োগের মাধ্যমে চুরি হওয়া সম্পদ ফিরিয়ে আনার কার্যক্রমের জন্য বাজেট বরাদ্দের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

তিনি পর্যাপ্ত মানবসম্পদ নিয়োগ ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা তৈরির মাধ্যমে বিএফআইইউ, এনবিআর, চুরি হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধার সংক্রান্ত টাস্কফোর্স ও ট্রান্সফার প্রাইসিং সেলের মতো অবৈধ অর্থ পাচার মোকাবেলায় নিয়োজিত সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা জোরদার করতে পর্যপ্ত সম্পদ বরাদ্দের পরামর্শ দেন।

সেলিম রায়হান কমিশন ও টাস্ক ফোর্সের সুপারিশগুলোর যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য বাজেট বরাদ্দের ওপর জোর দেন।

তিনি ডিজিটালাইজেশন, ডেটা বিশ্লেষণ ও মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বাজেট বরাদ্দের আহ্বান জানান।

তাসনিম আরেফা সিদ্দিকী বলেন, এশিয়ায় বাংলাদেশি অভিবাসীরা সবচেয়ে বেশি অভিবাসন ব্যয়ের সম্মুখীন হন। নেপালি কর্মীদের তুলনায় বাংলাদেশিরা ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি অর্থ প্রদান করেন।

তাসনিম আরেফা আরও বলেন, একজন বাংলাদেশি অভিবাসীর এই খরচ পুনরুদ্ধার করতে ১৭ মাস সময় লেগে যায়।

তিনি বলেন, শক্তিশালী নিয়োগ সংস্থা, নীতিনির্ধারক ও আমলারা ২০২১ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে মালয়েশিয়ায় একটি নিয়োগ সিন্ডিকেট তৈরি করে অভিবাসীদের কাছ থেকে ২ বিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিয়েছে।

আরেফা বলেন, গত এক দশকে রিক্রুটিং এজেন্সি ও মধ্যস্থতাকারীরা ভিসা ক্রয়ের জন্য অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে ১.৩৪ ট্রিলিয়ন টাকা হস্তান্তর করেছে। কারণ বহির্বিশ্বে এই উদ্দেশ্যে রেমিট্যান্স পাঠানোর অনুমতি নেই।

তিনি উল্লেখ করেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে চাঁদাবাজি, অর্থ ও অভিবাসী পাচারের সিন্ডিকেটের দুই প্রধান ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার ও প্রত্যর্পণের জন্য মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছে।

তাসনিম বলেন, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত আন্তর্জাতিক শ্রম অভিবাসন খাতে  ২০২০-২০২২ থেকে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেটের মাত্র ০.০৮ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এই খাতের জন্য বার্ষিক জাতীয় বাজেটের ন্যূনতম ১ শতাংশ বরাদ্দ প্রয়োজন।

তিনি একটি সার্বিক অভিবাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে অভিবাসনের আগে, অভিবাসনকালে এবং বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পরে- অভিবাসনের সকল পর্যায়ে অভিবাসী নারী-পুরুষ ও তাদের পরিবারের সদস্যদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি সম্বলিত ‘অভিবাসন দশক’ ঘোষণা করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

ম. তামিম বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহের কুইক এনফোর্সমেন্ট অব ইলেকট্রিসিটি অ্যান্ড এনার্জি সাপ্লাই (বিশেষ প্রবিধান), ২০১০-এর অধীনে মোট ৪২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে পুরস্কৃত করা হয়েছে, যা জরুরি অবস্থার অজুহাতে চালু করা হয়েছিল। কিন্তু এগুলো দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।

তিনি আরও বলেন, এই বিষয়ে গোপন চুক্তির আনুমানিক মূল্য ৩ বিলিয়ন ডলার।