বাসস
  ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৯:১০
আপডেট : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২০:৫০

অনির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষাবলম্বনকারীদের নিন্দা প্রধানমন্ত্রীর 

ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ (বাসস): প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য যারা একটি অনির্বাচিত সরকারের পক্ষে কথা বলছেন তাদের নিন্দা করে ২০০৭-২০০৮ সময়কালে এমন সরকারের কাছ থেকে কারা লাভবান হয়েছিল তা ভাবতে বলেছেন।
 তিনি বলেন, ‘২০০৭-২০০৮ সালে একটি অনির্বাচিত সরকার (বাংলাদেশে) ছিল এবং এতে কার কি লাভ হয়েছিল? বরং অশুদ্ধ হয়েছিল দেশের সংবিধান। ক্ষতি হয়েছিল দেশের মানুষের জীবনমানের।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিকেলে রাজধানীর বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণে মাসব্যাপী 'অমর একুশে বইমেলা-২০২৩' উদ্বোধনকালে দেয়া প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, “আমাদের দেশে (তথাকথিত) খুব জ্ঞানী বিজ্ঞানী আছেন। তাদের কাছে আবার এটাও শুনলাম দুই-চার বছরের জন্য যদি অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসে তাহলেও তো আর মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।” 
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাজেই আপনারা বুঝতে পারেন কারা বলতে পারে? ২০০৭-২০০৮ সালেতো অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় ছিল, কার কি লাভ হয়েছিল? কারণ, কিছু এগাছের ছাল ওগাছের বাকল নিয়ে একটা দল করার চেষ্টা, এদল সে দল থেকে ভিড়িয়ে দল করার চেষ্টা, আমরা রাজনীতিবিদরা সব খারাপ আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে জেলে ভরা হল এবং কিছু কিছু সুযোগ সন্ধানী তখন মাথা তুলে দাঁড়ালো এবং কিংস পার্টি গঠনসহ বিভিন্ন রকম প্রচষ্টা চালালো।
প্রধানমন্ত্রী এর উত্তরে বলেন, “মহাভারত অশুদ্ধ হবে না এটা ঠিক। কিন্ত অশুদ্ধ হবে আমাদের সংবিধান। লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা এবং এর ৮ মাসের মাথায় জাতির পিতা আমাদের দিয়েছিলেন এই সংবিধান। আর অশুদ্ধ হবে বাংলাদেশের মানুষের জীবন মান। কারণ, ঐ দুই বছরের অভিজ্ঞতা যদি একটু স্মরণ করেন। তখন ব্যবসা-বাণিজ্য, সহিত্য চর্চা, অথনৈতিক অবস্থা সবই বিপর্যস্থ হয়ে গিয়েছিল। একটা বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয় যখন তখন সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়।”
সেই নির্বাচনে বিএনপি ৩০ টি আসনে এবং বাকী আসনে আওয়ামী লীগ নেতৃতাধীন মহাজোট বিজয়ী হয়। এরপর থেকে জনগণের জন্য কাজ করে জনণের সমর্থন নিয়েই আওয়ামী লীগ এ পর্যন্ত ক্ষমতায় রয়েছে, বলেন তিনি।
 তাঁর সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করেছিল বলেই দেশে এখন গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রয়েছে বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে এবং প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানা। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। সংস্কৃতি সচিব মো. আবুল মনসুরও বক্তব্য রাখেন।
বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেনের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মহাপরিচালক মোহাম্মদ নুরুল হুদা। আরও বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি আরিফ হোসেন ছোটন।
অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত সাতটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। যার মধ্যে রয়েছে- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পাদিত শেখ মুজিবুর রহমান রচনাবলি-১, কারাগারের রোজনামচা পাঠ বিশ্লেষণ, অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাঠ বিশ্লেষণ ও আমার দেখা নয়াচীন পাঠ বিশ্লেষণ; রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ রচিত 'আমার জীবন নীতি, আমার রাজনীতি' এবং জেলা সাহিত্য মেলা ২০২২ (১মখন্ড)।
এছাড়া, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২২ প্রাপ্ত ১৫ জন কবি লেখক ও গবেষকের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলেন-ফারুক মাহমুদ ও তারিক সুজাত (যৌথভাবে কবিতায়), তাপস মজুমদার ও পারভেজ হোসেন (যৌথভাবে কথাসাহিত্যে), মাসুদুজ্জামান (প্রবন্ধ/গবেষণায়), আলম খোরশেদ (অনুবাদ), মিলন কান্তি দে এবং ফরিদ আহমদ দুলাল (যৌথভাবে নাটকে), ধ্রুব এষ (কিশোর সাহিত্য), মুহাম্মদ শামসুল হক (মুক্তিযুদ্ধের উপর গবেষণা), সুভাষ সিংহ রায় (বঙ্গবন্ধুর উপর গবেষণা), মোকারম হোসেন (বিজ্ঞান/বিজ্ঞান কথাসাহিত্য/পরিবেশ বিজ্ঞান), ইকতিয়ার চৌধুরী (জীবনী/স্মৃতিকার/ভ্রমণকাহিনী) এবং আব্দুল খালেক এবং মুহাম্মদ আব্দুল জলিল (যৌথভাবে লোককাহিনীতে)।
এরআগে জাতীয় সঙ্গীত এবং অমর একুশের সঙ্গীত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ সমবেত কন্ঠে পরিবেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপরই সকলে অমর একুশের শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করেন।
উদ্বোধনী স্মারকে স্বাক্ষর করে বইমেলা উদ্বোধনের পর বিভিন্ন স্টলগুলো ঘুরে দেখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা- কখনো হেফাজতী আন্দোলন, কখনো হলি আর্টিজান বেকারীতে সন্ত্রাসি হামলা, সরকার গঠনের সাথে থাথে বিডিআর এর ঘটনার মতো একটার পর একটা ঘটনা এসেছে। এরপর আবার নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এই সব মোকাবেলা করেও আমরা আমাদের অর্থনীতির গতিকে সচল রাখতে সক্ষম হয়েছি। আর দেশে একটা স্থিতিশীলতা আছে। মনে হয়, দেশে এমন কিছু লোক রয়েছে- যাদের দেশের স্থিতিশীলতা ভাল লাগেনা একথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ কারো যদি ক্ষমতায় যাবার ইচ্ছে থাকে তাহলে তাকে জনগণের কাতারে দাঁড়াতে হবে, ভোট করতে হবে, নির্বাচনে আংশ নিতে হবে। তারপর জনগণ যাকে চাইবে, তারা ক্ষমতায় আসবে। তিনি বলেন, নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার জন্য আজ ছবিসহ ভোটার তালিকা, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, আইডি  কার্ডসহ নির্বাচন ব্যবস্থায় সংস্কার তো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রস্তাবেই করা হয়েছে, যেন মানুষ স্বাধীনভাবে তার ভোট দিতে পারে। শান্তিপূর্ণ ভাবে তারা তাদেও অধিকারটা প্রয়োগ করতে পারে। আমরা সেটাই চাই এবং সে ব্যবস্থাটাই আমরা করেছি’।
আওয়ামী লীগ সরকার কাজের মধ্যদিয়ে মানুষের সমর্থন আদায় করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা নির্বাচনে ৩০টি সিট (২০০৮ সালে) পেয়েছিল, তারা সিট পাবে কোথা থেকে ? তিনি বলেন, ‘এটাতো আর আমাদের অপরাধ নয়, কারণ আমাদের প্রচেষ্টাই থাকবে জনগণের জন্য কাজ করার,’। তিনি বলেন, ‘জাতির পিতার পদাংক অনুসরণ করে তাঁর সরকার ভুমিহীন-গৃহহীনকে ঘর করে দিচ্ছে, জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে । একেবারে তৃণমূলের বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ - বেদে, হরিজন, কুষ্ঠরোগী, মান্তা শ্রেনী- কেউই এই সুবিধা থেকে বাদ যাচ্ছেনা। এ পর্যন্ত ৭ লক্ষ পরিবার এর উপকার ভোগী। আরো ৪০ হাজার ঘর নির্মাণ করে দিলে আমরা বলতে পারবো, বাংলাদেশে আর কেউ ভুমিহীন নেই। তারপরেও যদি থাকে, আমরা তা খুঁজে বের করছি’। তাঁর সরকার স্বাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৫ ভাগে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আড়াই কোটি শিক্ষার্থীকে বৃত্তি-উপবৃত্তি দেয়া হচেছ, উচ্চশিক্ষার জন্য ও গবেষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ডসহ অন্যান্য মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। তাঁর সরকার যে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে সকলের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে, সেটা তো বিজ্ঞান, কৃষিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণারই ফসল।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজ দেশের এই স্থিতিশীল পরিবেশকে নষ্ট করার অনেকরকম চক্রান্ত হবে। তবে আমি জনগণের ওপর বিশ^াস করি, জনগণের জন্য কাজ করি, আর দেশের সেবা করাটাই আমাদের লক্ষ্য।’ তিনি বলেন, দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় আজ ২ হাজার ৮শ’ ২৪ মার্কিন ডলার হয়েছে, যেটা আরো বাড়তো, কিন্তু করোনা মাহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং একে ঘিরে স্যাংশন ও পাল্টা স্যাংশনে এর গতিটা কিছুটা স্তিমিত হয়েছে। তবুও জাতির পিতা যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশ গড়ার সময় যে বলেছিলেন ‘তাঁর মাটি আছে, মানুষ আছে’ তা দিয়েই বাংলাদেশকে গড়ে তুলবেন। তাঁর সরকারও সেই লক্ষ্যে সেভাবেই এগুচ্ছে। দেশের বিত্তবানরাই সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার উল্লেখ করে, সরকার প্রধান বিদ্যুৎ, পানি ও জ¦ালানির ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার জন্য তাঁর আহবান পুণর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা কত ভুর্তকি দেবো ? হ্যাঁ, আমরা একটা জায়গায় ভুর্তকি দেবো- সেটা হচ্ছে খাদ্য ও কৃষিতে। বাংলাদেশের মানুষের যাতে খাদ্যাভাব না হয়। সেজন্য কৃষি ও খাদ্যে ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘যে দামে গ্যাস ও বিদ্যুৎ কিনতে হয়! সাধারণ মানুষ সামান্যই  বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। কিন্তু বিদ্যুৎ ব্যবহার করে বেশি বিত্তশালীরা। ঝাড়বাতি থেকে শুরু করে লিফট- এগুলোতে তো বিত্তশালীরাই বিদ্যুৎ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে। তারাই সুফল ভোগ করে।’ প্রধানমন্ত্রী এসময় গুজবে কান না দেয়ার জন্য তাঁর আহবান পুণর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘আপনারা অনেক সময় অনেক কিছু শোনেন। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করে দিয়েছি, এটার যেমন সুফল রয়েছে তেমনি কিছু কুফলও বয়ে এনেছে। এটা সব দেশেই রয়েছে। কাজেই যে যাই দেখেন, যাই শোনেন অন্ততপক্ষে বাস্তব চিত্রটা জেনে নিয়ে তারপরে একটা মতামত নেবেন, সেটাই আমি চাই’। 
প্রধানমন্ত্রী বহুদিন পর বইমেলায় সশরীরে আসতে পেরে আনন্দ প্রকাশ করে বলেন, আন্তর্জাতিক সাহিত্য মেলার ব্যবস্থা এবং জেলায় জেলায় বই মেলাটা অব্যাহত থাকবে। সহিত্য চর্চা এবং বই পড়ার অভ্যাসটা যেন আমাদের নবীন প্রজন্মের শিশুকাল থেকেই আসে এবং শিশু সাহিত্যটা আরো বেশি দরকার আমাদের। শিশুদের জন্য আরো বেশি লেখা দরকার, তাদের জন্য আকর্ষণীয় কিছু থাকা দরকার। সেদিকেও সকলে দৃষ্টি দেবেন। তরুণ প্রজন্মকে খেলাধুলা ও সংস্কৃতির দিকে যতবেশি মনোযোগি করা যাবে, তারা ততবেশি সৃজনশীল হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তরুণ প্রজন্মকে সাহিত্যের দিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদেরকে যত বেশি সাহিত্য, খেলাধুলা ও সংস্কৃতির দিকে আনা যাবে, তারা ততোটা সৃজনশীল হবে। খেলাধুলা ও সংস্কৃতির দিকে তাদেরকে ফিরিয়ে আনলে মাদক ও সন্ত্রাস থেকে দূরে থাকবে তারা।’ বাংলা ভাষাকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করাতে অনুবাদ সাহিত্যে জোর দেয়ারও আহবান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘সারাদেশে কালচারাল সেন্টার করা হয়েছে। জেলায় জেলায় বইমেলা করছি। এভাবে আমাদের বিভিন্ন দেশেও বইমেলা করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। কূটনীতিকদের মাধ্যমে সেই ব্যবস্থাটা করা প্রয়োজন। এতে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। সারাবিশ্বে বইমেলা করতে পারলে, আমাদের সুনামও ছড়িয়ে পড়বে।’ শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের সাহিত্যের আলাদা একটা মাধুর্য আছে। আমাদের দেশের নদী-নালা, খাল-বিল, বন, পাখির ডাক সব কিছুর মধ্যেই আলাদা একটা সুর আছে, ছন্দ আছে। বিদেশিরা আমাদের ভাষা সম্পর্কে আরও জানতে পারুক, সেটাই আমরা চাই।  দেশের প্রত্যেকটা সাহিত্য কর্মের অডিও ভার্সন করে দিলে আরও বেশি পাঠক তৈরি হবে। তরুণ প্রজন্ম অডিও শুনতেই বেশি অভ্যস্ত। তবে, কাগজের বইয়ের অনুভূতিই অন্য রকম।