বাসস
  ২২ আগস্ট ২০২১, ০৮:৫২
আপডেট : ২২ আগস্ট ২০২১, ১৩:৫৫

সঙ্গীতানুরাগী বঙ্গবন্ধু ও আমাদের জাতীয় সঙ্গীত

॥ জয়শ্রী জামান ॥
ঢাকা, ২২ আগস্ট, ২০২১ (বাসস) : আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’র প্রতি অনেক আগে থেকেই বঙ্গবন্ধুর বিশেষ টান ছিল উল্লেখ করে প্রখ্যাত রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী ড. সনজীদা খাতুন বলেন, ষাটের দশকে পাকিস্তানী শাসকদের রবীন্দ্র বিরোধিতার কালে তিনি এর প্রমাণ পেয়েছেন।
প্রবীণ শিল্পী সনজিদা খাতুন নানান শারীরিক জটিলতায় আজকাল কারো সঙ্গে খুব একটা কথা না বললেও উৎসাহ নিয়ে বাসসের কাছে এক ঘটনার স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় আমার সোনার বাংলা’ শীর্ষক তাঁর এক লেখায়ও তিনি এ ঘটনা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ষাটের দশকে একবার কার্জন হলে একটি অনুষ্ঠানে আমাকে গান গাইতে বলা হয়েছিল। আমি খুব বিস্মিত হয়ে গেলাম গান গাইতে। কী গান গাইবো? এমন সময় জানা গেল শেখ মুজিব সেখানে আসবেন। তখন তিনি কেবলই শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু বলা হতো না তাঁকে। তিনি লোক দিয়ে আমাকে বলে পাঠালেন আমি যেন ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটা গাই। আমি খুব ঘাবড়ে গেলাম। পাঁচটি স্তবকের এত লম্বা একটা গান আমার মুখস্ত নেই। তখন তো আর এটা জাতীয় সঙ্গীত নয়। পুরো গানটা আমি কেমন করে শোনাবো? তখন ছাত্ররা চেষ্টা করে গীতবিতান সংগ্রহ করে এনে দিলেন। আমি কোনমতে গানটি গেয়েছিলাম।
সনজিদা খাতুন বলেন, তিনি এইভাবে গান শুনতে চাওয়ার কারণ কি ছিল? পরে জানলাম সেই অনুষ্ঠানটি তৎকালীন পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্যদের জন্য আয়োজন করা হয়েছিল। গণপরিষদের পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্যরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাদের দেখাতে চেষ্টা করেছিলেন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি  তোমায় ভালবাসি’ কথাটা আমরা কত সুন্দর করে উচ্চারণ করি। এই গানটার ভেতরে যে অনুভূতি সেটা তিনি তাদের কাছে পৌঁছাবার চেষ্টা করেছিলেন এবং আমার তো মনে হয়, তখনই তার মনে এটাকে জাতীয় সঙ্গীত করবার কথা মনে এসেছিল।
ওয়াহিদুল হক, জাহেদুর রহিমকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু সঙ্গীতের আসর বসাতেন বলেও জানান তিনি।
‘আমার সোনার বাংলা’ রবীন্দ্র সঙ্গীতটিকে জাতীয় সঙ্গীত আর নজরুলের ‘চল চল চল’ গানটিকে বাংলাদেশের রণসঙ্গীত করেছেন বঙ্গবন্ধু।
বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামকে কলকাতা থেকে ঢাকায় এনে বাসভবন আর ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করেছেন।  কবির নামানুসারে ঢাকার একটি সড়কের নামকরণ করেন কাজি নজরুল ইসলাম এভিনিউ।
 স্বাধীন বাংলাদেশে কবি ফররুখ আহমেদকে অনুদান প্রদান, শিল্পী কমল দাস গুপ্তকে রেডিওতে সুযোগ দান, কবি জসীম উদ্দীনকে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ, অসুস্থ কবি হুমায়ুন কাদির, আবুল হাসান, মহাদেব সাহাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ প্রেরণ করেন জাতির পিতা।
নদীমাতৃক বাংলার মাটির দুর্জয় ঘাঁটিতে বিভিন্ন সময়ে এসেছে আর্য, অনার্য, সেন, তুর্কী, পাঠান, মোগল, পর্তুগীজ, ইংরেজ আর পাকিস্তানীরা। তারা চাপিয়ে দিতে চেয়েছে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি। কিন্তু, হাজার বছর ধরে বাঙালি তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আগলে রেখেছে। আর পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একজন মহাবিদ্রোহী বীর সন্তানের অপেক্ষায় তাদের থাকতে হয়েছে হাজার বছর।
অবশেষে তিনি এলেন, বাংলার সেই প্রবাদ পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বৃটিশ সাংবাদিক ডেভিট ফ্রস্ট বলেছিলেন, ‘মুজিব ইজ এ ম্যাজিক ওয়ার্ড, মুজিব ইজ এ মিরাকল নেম।’
বঙ্গবন্ধুকে সঙ্গীত প্রেমিক হিসেবে বর্ণনা করলেন সমাজ সেবায় একুশে পদক, বাচশাস পুরস্কারসহ একাধিক পদকে ভূষিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী অধ্যাপক ডা. অরূপ রতন চৌধুরী। একজন নেতা, একজন রাষ্ট্রনায়ক যে এতোটা সঙ্গীতানুরাগী হতে পারেন তা অত্যন্ত বিরল বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির প্রতি বঙ্গবন্ধু অন্তরের অন্তস্থল থেকে আলাদা টান অনুভব করতেন।’
বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সংঙ্গীতানুরাগ স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৯৬৯-৭০-এ যুদ্ধ শুরুর আগে ডাকসু’র সাংস্কৃতিক আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। এ সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের ’আমার সোনার বাংলা,’ ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে,’ ‘ও আমার দেশের মাটি’ এবং নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট,’ ‘এই শিকল পরা ছল,’ ডি এল রায়ের ‘ধন ধান্য পুষ্পে ভরা’ গানগুলো ধ্যানমগ্ন হয়ে শুনতেন বঙ্গবন্ধু। পুত্র শেখ কামাল ছায়ানটে গান শিখতেন। তার ‘স্পন্দন’ শিল্পী গোষ্ঠির উল্লেখ করেন অরূপ রতন। শত কণ্ঠে গাওয়া মুজিববর্ষের থিম সং ‘তুমি বাংলার ধ্রুবতারা/তুমি হৃদয়ের বাতিঘর’-গানে বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠা কন্যা শেখ রেহেনার কন্ঠ দেয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবারই খেলাধূলা, শিল্প, সংস্কৃতি ও সংঙ্গীতের প্রতি যথাযথই অনুরক্ত যা সত্যিই বিরল।
‘কেবল সঙ্গীত নয় বঙ্গবন্ধু বাঙলা ও বাঙ্গালীর জন্য মঙ্গলজনক সব কিছুরই অনুরাগী ছিলেন’ মন্তব্য করেন  সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠযোদ্ধা সুজেয় শ্যাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ২০১৪ সালের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে শুদ্ধ সুরে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের আয়োজক সুজেয় শ্যাম জানান, ১৯৭৫ সালের ২৫ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে শহীদ আলতাফ মাহমুদ, রাজু আহমেদ, সর্দার আলাউদ্দিন, আবুল কাশেম সন্দ্বীপসহ বাংলাদেশের ১৮ জন এবং ভারতীয় ৪ জন বিশিষ্ট শিল্পী, সংস্কৃতিসেবী ও বেতারকর্মীর জন্য বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক ঘোষণা করা হয়েছিল। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর তা থেমে যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরবর্তীতে আবার এই পদক প্রদান শুরু করেছেন।
তিনি জানান, এফডিসির প্রতিষ্ঠাসহ বাংলাদেশের ছায়াছবির গোড়াপত্তন করেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সোভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মানি, হাঙ্গেরি. মঙ্গোলিয়া ভারত থেকে আগত কবি সাহিত্যিকদের অংশগ্রহণে একটি সাহিত্য সম্মেলন উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি জানান, ওই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে বলেছিলেন, ‘দীর্ঘকালব্যাপী নানা শোষণ এবং বঞ্চনার ফলে রাজনৈতিক দিক থেকে আজ আমরা দরিদ্র, ক্ষুধার্ত ও নানা সমস্যায় জর্জরিত কিন্তু সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দিক থেকে আমরা দরিদ্র নই। আমাদের ভাষার দু’হাজার বছরের একটি গৌরবময় ইতিহাস আছে।’
‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি বঙ্গবন্ধুর অন্তরঙ্গ প্রণোদনায় কিভাবে আমাদের বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হল সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শিল্পী কবির স্বপ্নময় আকাক্সক্ষার রঙে আঁকা রূপসী শব্দ কন্যা বাংলাদেশ আজ জ¦লজ¦লে সত্য। স্বপ্নকে যিনি সত্যে রূপায়িত করেছেন তিনি আর কেউ নন, তিনি এক ও অদ্বিতীয় আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতা, লেখায় বারবার উল্লেখ করেছেন যে, তিনি বাংলা ও বাঙালিকে স্বাধীন করার অনুপ্রেরণা, সাহস এবং শক্তি পেতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে। কবিগুরুর লেখা পড়ে বঙ্গবন্ধু  যেভাবে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে বাঙালি জাতিকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখেছিলেন তেমনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা, গান আর তার লেখা পড়েও তিনি সমানভাবে উজ্জীবিত হতেন।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু নিজে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আমি যখন শেষ বারের মতো জনসভা করি, যেখানে ১০ লাখ লোক হাজির হয়েছিল আর তখন ‘স্বাধীন বাংলার’ স্লোগান দিচ্ছিল, তখন ছেলেরা সোনার বাংলা গাইতে শুরু করে। আমরা সবাই, ১০ লাখ লোক দাঁড়িয়ে গানটাকে শ্রদ্ধা জানাই। তখনই আমরা আমাদের বর্তমান জাতীয় সঙ্গীতকে গ্রহণ করে নিই।’ এ প্রসঙ্গে ডা. অরূপ রতন চৌধুরী বলেন, এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর একক সিদ্ধান্ত। আর এ সিদ্ধান্ত গ্রহন কেবল তাকেই মানাতো।