বাসস
  ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:১২

যমুনার চরে ভেড়া পালন করে স্বাবলম্বী নারীরা

প্রতীকী ছবি। পিক্সাবে

ঢাকা, ১৪ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস): মোছাম্মৎ রাবেয়া খাতুন। বয়স চল্লিশের কোঠায়। সড়ক দুর্ঘটনায় অটো রিকশাচালক স্বামী মো. আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুর পর অন্যের জমিতে কাজ করেই তিন সন্তান নিয়ে সংসারের হাল ধরেছেন। পাশাপাশি ভেড়া পালন শুরু করেন। শুরুতে দুয়েকটি ভেড়া থাকলেও এখন তার ১৫টি ভেড়া রয়েছে। তার সঙ্গে দুই ছেলে সালাম ও সোলেমানও ভেড়ার দেখভাল করেন। শুরুতে কষ্ট করলেও এখন তিনজনের আয় দিয়ে সংসার চালিয়ে সঞ্চয়ও গড়েছেন কিছু। এখন রাবেয়া স্বাবলম্বী।

শুধু রাবেয়া-ই নয়, গাইবান্ধায় ভাঙন কবলিত যমুনা চরের প্রায় সকল নারী-পুরুষের একই গল্প। দুর্যোগকবলিত যমুনা নদীর বালু চরে দুর্যোগ সহনীয় ভেড়া পালন করে সাবলম্বী হচ্ছে চরের নারীরা। উন্নত জাত, দুর্যোগ সহনীয় ও প্রজনন ক্ষমতা বেশি হওয়ায় ভেড়া পালনে ঝুঁকে পড়েছে চরের নারীরা। এতে সংসারের চাহিদা মিটিয়ে আর্থসামাজিক উন্নয়নের স্বপ্ন দেখছে তারা।

সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের গুচ্ছগ্রামের চর সিধাইয়ের তেমনই একজন স্বাবলম্বী নারী সাবিনা বেগম (৩৫)। কৃষক স্বামীসহ অভাবের সংসারে চার সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণ ছিল খুবই কষ্টের।

তিনি বলেন, আমাকে বিনামূল্যে একটি ভেড়া দেওয়া হয়। সেখান থেকে ২০ থেকে ২২টি ভেড়া বিক্রি করেছি। এখন ভেড়ার সংখ্যা ১২টি। প্রতি বছর ভেড়া বিক্রি করে তার আয় লাখ টাকার বেশি। একটি ছোট ভেড়ার দাম ৩ হাজার ও বড় ভেড়া ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। একটা দিয়ে ভেড়া পালন শুরু করেন তিনি।

তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে এলাকার প্রায় ৩০টি পরিবার ভেড়া পালন করে সচ্ছলতা এনেছে। 

চর সিধাইয়ের গৃহবধূ আছমা আক্তার (৩৭)। তিনিও বছর তিনেক আগে শুরু করেন ভেড়া পালন। একটি ভেড়া দিয়ে শুরু করেন। ১৬ থেকে ১৮টি ভেড়া বিক্রির পর তার এখনো ৮টি ভেড়া আছে। স্বামী ছানোয়ার হোসেন কৃষিকাজ করেন। ভেড়ার বাচ্চা ও বড় ভেড়া বিক্রি করে সংসারে সচ্ছলতা এনেছেন তিনি। 

জানা গেছে, উপজেলার কড়াইবাড়ী চরের ছকিনা বেগম (৫৫), মল্লিকা বেগম (৬৫), কোহিনুর বেগম (৪০), নার্গিস আক্তার (৩২) ও মর্জিনা বেগম (৬০) ভেড়া পালনে দেখেছেন সাফল্যের মুখ। ভেড়া পালন করেই চলছে তাদের সংসার।

আরেক সুবিধাভোগী মল্লিকা বেগম জানান, তার পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ ছিল। ফ্রেন্ডশিপ থেকে ভেড়া পালন ও সবজি চাষের পরামর্শ দেন। সেই থেকে ভেড়া ও সবজি বিক্রি করে সচ্ছলতা ফিরেছে তার।

মোল্লার চরের সাবেক চেয়ারম্যান সাইদুজ্জামান জানান, গাইবান্ধার তিস্তা যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর বুকজুড়ে ১৬৫টি চর রয়েছে। গাইবান্ধার, ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জসহ চার উপজেলার এসব চরে অন্তত ৩ লাখ মানুষ বাস  করে। বিশেষ করে তিস্তাসহ তিন নদীর দুর্গম চরাঞ্চল কাপাসিয়া, বেলকা, তারাপুর, হরিপুর। গাইবান্ধার মোল্লারচর, কামারজানি, এ্যাড়েন্ডাবাড়ি, উড়িয়া ও কঞ্চিপাড়া। সাঘাটা উপজেলার হলদিয়া, কামালেরপাড়া, সাঘাটা সদরসহ অন্তত ১৩টি ইউনিয়ন দুর্গম চরাঞ্চল।

চরাঞ্চলের বাসিন্দা ও উপকার ভোগী শিল্পি বেগম বলেন, এসব এলাকার প্রায় ৩ লাখ মানুষ তাদের জীবন-জীবিকা যাপনে চাষাবাদ ও গবাদী পশু সম্পদের ওপর নির্ভর করে। তারা সারা বছর কোনো না কোনো দুর্যোগ মোকাবিলা করে বুক উঁচু করে বাস করে। বিয়েসহ অন্যান্য বিপদ কাটে গরু ছাগল হাঁস মুরগি বিক্রি করে। তারপরেও তারা সুখি মানুষ। গবাদী পশু সম্পদ হিসাবে পালন করলেও এই চরগুলোতে কোন ভেড়া পালনের প্রচলন ছিল না। 

তিনি বলেন, ‘আমি একটি ভেড়া পেয়েছি, তার অল্প কিছুদিনের মধ্যে আমি এখন পাঁচটি ভেড়ার মালিক হয়েছি। একেকটি ভেড়ার ওজনেও অনেক বেশি। দুর্যোগে বিক্রি করে সংসারে খরচ বহন করবো।'

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ফ্রেন্ডশিপ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিদ্যালয়ের গবেষণার নতুন সফলতা হিসেবে স্থানীয় নারীদের উন্নতজাতের ভেড়া দিয়েছেন। যেমন উচু, তেমন লম্বা। দেখতে বেশ সুন্দর। অল্প সময়ে অনেক বড় হওয়ায় তাদের আনন্দের সীমা নাই। 

সাজেদা বেগম নামে এক উপকারভোগী বলেন, বলেন, ‘এই প্রজননের সফলতা হিসাবে ভেড়ার উন্নত জাত অন্তত ৩০ কেজি ওজন ও বছরে ৪ বার বাচ্চা দেয়। অল্প পুঁজি ও কম শ্রমে লাভজনক হওয়ায় চরাঞ্চলের নারীদের মধ্যে ভেড়া পালন দিন দিন বাড়ছে। এতে অনেকের অভাবের সংসারে সচ্ছলতা এসেছে।’

ফ্রেন্ডশিপ কর্মকর্তা দিবাকর বিশ্বাশ বলেন, সারা বছর বন্যা, খড়া, নদী ভাঙনসহ বিভিন্ন দুর্যোগের সাথে যুদ্ধ করে চরবাসীদের বাঁচতে হয়। সে কারণে পশু সম্পদ রক্ষা করা তাদের কঠিন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কাবিলপুর চরজুরে উন্নত জাতের ভেড়ার দেখা মেলে। 

তিনি বলেন, বাংলাদেশ কৃষি বিদ্যালয়ের গবেষণায় এই নতুন জাতের ভেড়া সারা ফেলেছে। দেশি প্রজন্মের সাথে উন্নত জাতের ভেড়ার বীজ ক্রস করে নতুন জাতের ভেড়া উৎপান করা হয়েছে। দুর্যোগ সহনশীলতা অর্জনে এই ভেড়া পালনে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। ভেড়া পালন করে আর্থিক সচ্ছলতা ফিরেছে চরাঞ্চলের ২ শতাধিক নারীর। 

মোমেনা বেগম নামে একজন নারী জানান, এই জাতের ভেড়া পালনে খরচ কম, দুর্যোগ সহনীয়, রোগবালাই কম হয় এবং আকারে বড় হয়। কাবিলপুর চরের ২৪০ জন নারী ২৪০টি ভেড়া দিয়ে ভেড়া পালন শুরু করেন। 

প্রজনন ক্ষমতা বেশি হওয়ায় ইতোমধ্যে তারা একটি  থেকে ৮ থেকে  ১০টি করে ভেড়ার মালিক হয়েছেন। এই পরিবারগুলো এখন ভেড়া পালন করে নতুন আশার স্বপ্ন দেখছেন। সংসারের চাহিদা, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ জুগিয়েও নিজেরা স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। 

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মাছুদার রহমান সরকার বলেন, এইটা ভেড়ার নতুন জাত। উন্নত মানের ভেড়ার সাথে ক্রস করে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয় এই ভেড়া উদ্ভাবন করেছেন। চরাঞ্চলের দুর্যোগ এলাকায় এই ভেড়া চাষ করে অনেকেই অল্প সময়ে স্বাবলম্বী হতে পারে।