শিরোনাম
।। মো. আয়নাল হক ।।
রাজশাহী, ২ মার্চ, ২০২৫ (বাসস): জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সর্বত্র পরিবেশগত সংকট ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুপ্রবণ রাজশাহীর বিস্তীর্ণ বরেন্দ্র অঞ্চল হুমকির মুখে পড়েছে। পরিবেশগত এই সংকট প্রশমনের জন্য বনায়নে জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
এই বিষয়ে অভিজ্ঞতার আলোকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস (আইইএস) এর অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা বলেন, অতিরিক্ত তাপ, বৃষ্টিপাত কম হওয়া ও সেচের পানির ঘাটতি কৃষি ব্যবস্থার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বনভূমি হ্রাসের ফলে বৃষ্টিপাত হ্রাস ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি কৃষি উৎপাদনের পাশাপাশি মানুষের জীবনযাত্রার জন্য হুমকি স্বরূপ।
তিনি বলেন, বর্তমান কৃষকরা খরা ও তাপপ্রবাহসহ একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, যা তাদের কৃষি কাজের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়াও, বিদ্যমান নদীগুলো, বিশেষ করে পদ্মা ও তার উপনদীগুলো এবং অন্যান্য জলাশয়ের জলস্তর আরও কমে গেছে, যার ফলে এই অঞ্চলের সমগ্র বাস্তুতন্ত্র এবং কৃষি উৎপাদনের উপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
পদ্মা নদীর নাব্যতা পুনরুদ্ধারের জন্য খননের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়ে অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা বলেন, পদ্মা নদীর তলদেশ পরিষ্কার করা জরুরি হয়ে উঠেছে, অন্যথায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে, আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাত হ্রাস পাবে। পদ্মা নদীর জলপ্রবাহ অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পাচ্ছে, যার ফলে এর মূলধারা ও উপনদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে খরাপ্রবণ বরেন্দ্রভূমির পরিবেশের উপর প্রভাব পড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পদ্মার পানির স্তর ধীরে ধীরে নেমে যাওয়ার বিরূপ প্রভাবে দেশের সমগ্র উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল, বিশেষ করে বিশাল বরেন্দ্র অঞ্চল পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এনভায়রনমেন্টার সায়েন্সেস (আইইএস) এর আরেক অধ্যাপক রেদওয়ানুর রহমান বলেন, পানির স্তর দ্রত হ্রাস পাচ্ছে এবং চলমান শুষ্ক মৌসুমে এটি সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যার ফলে নদীর তলদেশে বিপুল সংখ্যক বালুর স্তূপ হয়েছে। এখন কিছু খালে জলপ্রবাহ সর্বনিম্ন, যার ফলে উজানে ও ভাটিতে উভয় দিকেই নাব্যতা ব্যাহত হচ্ছে।
তিনি বলেন, নদীতে স্বাভাবিক জলপ্রবাহ এখন বছরে মাত্র তিন থেকে চার মাস দৃশ্যমান। অন্য সময়ে পানির স্তর সর্বনিম্ন ভাটায় নেমে যায়, যার ফলে নদীর ওপারে দীর্ঘ বালুকাময় চর তৈরি হয়, যার ফলে চরাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে।
অধ্যাপক রেদওয়ানুর রহমান আরও বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এই মৌসুমে পানির স্তর আরও বেশি কমে যাচ্ছে।
তিনি আশঙ্কা করেন, জুলাই মাসে বর্ষা শুরু না হওয়া পর্যন্ত যদি এই হ্রাসের ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে এটি সমগ্র উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলকে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
অধ্যাপক রেদওয়ানুর রহমান বলেন, বিশাল বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে, যার ফলে হস্তচালিত নলকূপগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ছে। পদ্মা নদীতে নির্বিচারে কঠিন ও তরল উভয় বর্জ্যই ফেলা হচ্ছে, যা পানি দূষণ ও নদী ভাঙনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি হুমকি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, পদ্মা নদী ও শহরের সুরক্ষা বাঁধে কঠিন ও তরল বর্জ্য ফেলা হয়। রাজশাহীর অঞ্চলের পদ্মা নদী অবৈধ দখল ও দূষণের শিকার হয়েছে। কারণ ঘরবাড়ির ভাঙা টাইলস ও কংক্রিটের টুকরো নদীর পাড়ে ফেলা হয়। নদী দখল, নির্বিচারে মাছ ধরা, অবৈধভাবে মাছ ধরার সরঞ্জাম ব্যবহার, নদীর পানিতে কৃষি রাসায়নিক দূষণ ও প্লাস্টিক দূষণের কারণে মাছের বৈচিত্র্য হ্রাস পেয়েছে।
তিনি বলেন, কয়েক বছর আগে, আমি পদ্মা নদীতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্লুইস গেট দিয়ে প্রবাহিত তরল বর্জ্য অধ্যয়ন করে দেখতে পাই, দূষণের মাত্রা ‘বিশাল এবং এটি ক্রমবর্ধমান। মাছের সংখ্যাও ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়াও কৃষিকাজে নদীর পানির ব্যবহারও স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে পদ্মার পানিতে ধাতু রয়েছে।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং কারখানায় বর্জ্য শোধনাগার থাকা উচিত, যা রাজশাহীতে নেই বলে জানান অধ্যাপক মিজানুর হমান।
বাসসের সঙ্গে আলাপকালে শুক্রবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাসানুর রহমান বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং খালি জায়গার অভাবে শহরে প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং সবুজের যথাযথ সংরক্ষণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়ছে। পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে প্রচুর জলাশয় ও জলাধার ছিল। কিন্তু বর্তমানে এর সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে, যা পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।