বাসস
  ১২ এপ্রিল ২০২৫, ১৬:০৯

যুগে যুগে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের দৃষ্টান্ত

ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল: ১৯৪৫, এই বিচারে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয় নেতাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় আনা হয়। ছবি : সংগৃহীত

।। দিদারুল আলম ও এস এম আশিকুজ্জামান ।।

ঢাকা, ১২ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনাগুলোর বিচার যুগে যুগে ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত হয়েছে।

মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো সাধারণত সংঘটিত হয়, যখন রাষ্ট্র বা সংগঠিত গোষ্ঠী কোনো জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি বা দাসত্ব আরোপ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানবতাবিরোধী অপরাধের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও বিচারের যাত্রা শুরু হয়।

ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল: ১৯৪৫ সালে নাৎসি নেতাদের বিচারের জন্য গঠিত হয় ন্যুরেমবার্গ আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনাল। এই বিচারে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয় নেতাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় আনা হয়। গণহত্যা, নির্যাতন ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে বহু নাৎসি নেতাকে শাস্তি দেওয়া হয়, যা পরবর্তীতে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার ভিত্তি স্থাপন করে।

যুগোস্লাভিয়ায় জাতিগত নিধনের বিচার: ৯০ দশকে যুগোস্লাভিয়ায় সংঘটিত জাতিগত সংঘর্ষে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। জাতিসংঘ ১৯৯৩ সালে গঠন করে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ফর্মার ইয়োগোস্লাভিয়া (আইসিটিওয়াই)। এই আদালতে সাবেক যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট স্লোবোদান মিলোসেভিচসহ বহু সামরিক ও রাজনৈতিক নেতার বিচার হয়। এই ট্রাইব্যুনালে সর্বমোট ১৬১ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়, যাদের মধ্যে ৯৩ জনের সাজা হয়। ১৮ জন খালাস পায় আর ৫০ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কারণে (যেমন মৃত্যু, ভিন্ন আদালতে স্থানান্তর ইত্যাদি) মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। আইসিটিওয়াই আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচার ব্যবস্থায় নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

রুয়ান্ডা গণহত্যার বিচার: ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় হুতু ও তুতসি সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষে মাত্র ১০০ দিনে প্রায় ৮ লাখ মানুষ নিহত হয়। জাতিসংঘ ১৯৯৫ সালে গঠন করে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনাল ফর রুয়ান্ডা (আইসিটিআর)। আদালতটি রুয়ান্ডার উচ্চপদস্থ রাজনৈতিক নেতা, সামরিক কর্মকর্তা ও মিডিয়া কর্মীদের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক রায় প্রদান করে। এই ট্রাইব্যুনালে সর্বমোট ৯৩ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। যাদের মধ্যে ৬১ জনের সাজা হয়, ১৪ জন খালাস পায় আর ৬ জন পলাতক। বাকিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কারণে (যেমন মৃত্যু, ভিন্ন আদালতে স্থানান্তর ইত্যাদি) মামলা নিষ্পত্তি হয়নি।

কেমার রুজের ভয়াবহতার বিচার: কম্বোডিয়ায় ১৯৭৫-৭৯ সালে কেমার রুজ শাসনের সময় প্রায় ২০ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। এই গণহত্যার বিচার করতে ২০০৬ সালে গঠিত হয় এক্সট্রাঅর্ডিয়ারি চেম্বার্স ইন দ্য কোর্ট অব কম্বোডিয়া (ইসিসিসি)। বিচার কার্যক্রম দীর্ঘ হলেও দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হয়।

হিসেন হাব্রে’র বিচার: আফ্রিকান রাষ্ট্র শাদ (চাদ)-এর স্বৈরাচারী শাসক হিসেন হাব্রে’র মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১২ সালে সেনেগাল ও আফ্রিকান ইউনিয়নের মধ্যকার চুক্তির মাধ্যমে সেনেগালে প্রতিষ্ঠিত হয় এক্সট্রাঅর্ডিনারী আফ্রিকান চেম্বারস। ২০১৫ সালে হিসেন হাব্রে’র বিচার শুরু হয় এবং ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত রায় দেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত: ২০০২ সালে রোম সংবিধি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) বিশ্বের প্রথম স্থায়ী আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত। সুদান, কঙ্গো, কেনিয়া, লিবিয়া ও আফগানিস্তানসহ অনেক দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের মামলার তদন্ত ও বিচার করছে আন্তর্জাতিক এই আদালত। এ যাবত সর্বমোট ৬৯ জনের বিরুদ্ধে এই আদালতে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০ জনের সাজা হয়েছে, ৪ জন খালাস পেয়েছেন আর ২০ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কারণে (মৃত্যু, ভিন্ন আদালতে স্থানান্তর, অভিযোগ খারিজ ইত্যাদি) মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। এছাড়া, বর্তমানে আইসিসি-তে ৪ জনের বিচার চলমান আছে এবং ১ জনের বিচার প্রি-ট্রায়াল চেম্বারে শুরু হয়েছে। ৩০ জন আসামী পলাতক রয়েছেন।

বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১০ সালে। এই ট্রাইব্যুনালের অধীনে ইতোমধ্যে একাধিক ব্যক্তির বিচার সম্পন্ন ও রায় কার্যকর হয়েছে। সর্বশেষ, ২০২৪ সালের  জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে এই আদালতে। গত ১০ এপ্রিলের তথ্য অনুযায়ী জুলাই আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধসহ মোট ৩৩৯টি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। যেখানে ৩৯টির  তদন্ত কার্যক্রম (কমপ্লেইন্ট রেজিস্টার অনুসারে) চলমান। তদন্তের প্রাথমিক সত্যতার আলোকে মিস কেইস হয়েছে ২২টি। এইসব মিস কেইসে সর্বমোট অভিযুক্ত ব্যক্তি ১৪১ জন। যাদের মধ্যে গ্রেফতার রয়েছেন ৫৪ জন আর ওয়ারেন্ট ভুক্ত পলাতক আসামী ৮৭ জন।