শিরোনাম
ঢাকা, ১৩ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : বছর ঘুরে আবারো ফিরে এসেছে বাংলা নববর্ষ। তবে এবারের বর্ষবরণ বাংলাদেশের সকল নাগরিক, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের কাছে অন্যরকম এক উৎসবের আবহ তৈরি করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এই প্রথমবারের মত দেশের সকল নাগরিক, সকল সম্প্রদায় ও নৃগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধভাবে আগামীকাল (সোমবার) সর্বজনীন লোকউৎসব ‘পহেলা বৈশাখ’ উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এ উপলক্ষে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশ সেজে উঠেছে নতুন সাজে, নেয়া হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি। বাঙালি জাতির শাশ্বত ঐতিহ্যের প্রতীক এ দিনটি উপলক্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় গত ৮ এপ্রিল এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ‘সরকার প্রথমবারের মতো ১৪৩২ সালের বাংলা নববর্ষ এবং চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা এবং গারো সহ অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর নববর্ষ উদযাপনের জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক উৎসব আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে।’ এর আগে, ২৩ মার্চ বাংলাদেশ সচিবালয়ে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এ কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হয়।
ঋতুর ওপর নির্ভরশীল কৃষিকাজ, আর কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল খাজনা আদায়। কৃষিনির্ভর বাংলার মানুষের সুবিধার্থে মোঘল সম্রাট আকবর বাংলা সন প্রবর্তন করেন। হিজরি চান্দ্র সন ও বাংলা সৌর সনের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত নতুন সনটিই একসময় ‘বঙ্গাব্দ’ নামে পরিচিত হয়।
বহু আগে থেকেই বাংলার কৃষক ও গৃহস্থরা চৈত্র মাসের শেষদিন ‘চৈত্রসংক্রান্তি’ পালন করতেন। কৃষকেরা এদিন ভূস্বামীদের হাতে বাকি থাকা সকল খাজনা তুলে দিতেন, আর ব্যবসায়ীরা পুরোনো বছরের সকল লেন-দেনের হিসাব চুকিয়ে নতুন বছর উপলক্ষে খুলতেন লালসালু মোড়ানো নতুন হালখাতা, যা এখনো ধরে রেখেছেন বাংলার অনেক ব্যবসায়ী।
বছরের প্রথম দিনটিকে আরো উৎসবমুখর করে তোলে শোভাযাত্রা ও বৈশাখী মেলা। এগুলো মূলত সর্বজনীন লোকজ উৎসব। বাঙালির আনন্দঘন লোকায়ত সংস্কৃতির ধারক গ্রামীণ বৈশাখী মেলাগুলোতে মেলে স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সব প্রকার হস্তশিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী, খেলনা এবং বিভিন্ন লোকজ খাদ্যদ্রব্য যেমন: চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা, বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি প্রভৃতির বৈচিত্র্যময় সমারোহ। আরো থাকে নাগরদোলা, পুতুলনাচ, যাত্রা, লোকজ গানের আসরসহ নানান বিচিত্র বিনোদন।
যুগ যুগ ধরে চলে আসা এ আনন্দ উৎসবটি একসময় আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে যায় এবং বাংলার চিরাচরিত এ অনুষ্ঠানটি এখনও পালিত হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় অন্যান্য বছরের মতন এবারো দেশে নানান আয়োজনে পালিত হবে দিনটি।
সরকারের নেয়া কর্মসূচি অনুযায়ী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, মহানগর ও পৌরসভা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি তিন পার্বত্য জেলা এবং অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক দলগুলির শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের সমন্বয় করবে। পহেলা বৈশাখকে স্বাগত জানাতে ভোরে রমনা বটমূলে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে ছায়ানট। বাংলা একাডেমি এবং বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক), বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এবং বাংলাদেশ লোকশিল্প ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন বৈশাখী মেলার আয়োজন করবে।
কর্মসূচি অনুসারে, পহেলা বৈশাখে প্রতিটি ইউনিয়ন, জেলা ও উপজেলা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সকল নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের অংশগ্রহণে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।বাংলা নববর্ষ উদযাপনের জন্য বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলো বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। সেইসঙ্গে, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ির জাতিগত গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো একই সাথে বৈসাবি উৎসব উদযাপন করবে।
জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে সকল জাদুঘর এবং প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। শিশু ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য এদিন লাগবেনা কোনো টিকিট।
বহুদিনের ঐতিহ্য অব্যাহত রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আগামীকাল উৎসবমুখর পরিবেশে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে সকাল ৯টায় চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ বের করার জন্য ইতোমধ্যেই সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। নতুন বর্ষবরণ উপলক্ষে দিনব্যাপী আনন্দ উৎসব চলবে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত।
বিপুলসংখ্যক অতিথির সমাগম উপলক্ষে দেশবাসীর উৎসাহের কেন্দ্রবিন্দু- পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নেয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সিসিটিভি ক্যামেরা, আর্চওয়ে গেইট, হেল্প ডেস্ক, কন্ট্রোল রুম, অস্থায়ী পাবলিক টয়লেট এবং অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্পসহ নেয়া হয়েছে নানা ধরনের ব্যবস্থা।
পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে জনগণের উদযাপনকে নিরাপদ ও সহজ করতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। আজ সকালে রমনা বটমূলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ শেষে এক ব্রিফিংয়ে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের মহাপরিচালক (ডিজি) এ কে এম শহিদুর রহমান বলেছেন,‘পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান ঘিরে পুলিশ, র্যাবসহ গোয়েন্দা বাহিনী সম্মিলিতভাবে কাজ করছে। সেইসাথে দেশব্যাপী গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, টিএসসি, শাহবাগ, রমনা, হাতিরঝিলসহ যেসব জায়গায় জনসমাগম হবে, সেখানে র্যাবের পর্যাপ্ত সদস্য মোতায়েন থাকবে। যে কোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে র্যাব সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে থাকবে বলে জানান তিনি।
সরকারের নেয়া কর্মসূচি অনুসারে, বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশের পরিবর্তে সংবাদপত্রগুলোতে পহেলা বৈশাখের তাৎপর্য তুলে ধরে বিশেষ ফিচার প্রকাশ করা হবে। এই উপলক্ষের উপর জোর দিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার এবং বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলসহ অন্যান্য প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া গুলো অনুষ্ঠান সম্প্রচার ও চিত্রিত প্রতিবেদন প্রকাশ করবে।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং সকল সরকারি ও বেসরকারি টিভি চ্যানেল, রেডিও স্টেশন, বাণিজ্যিক রেডিও এবং কমিউনিটি রেডিওতে শোভাযাত্রা সম্প্রচারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে।