বাসস
  ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ১৯:০৩

ঘরে বসেই বৈশ্বিক বিপণনে নাটোরের ওয়াহিদা, হয়েছেন স্বাবলম্বী

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

ঢাকা, ১৫ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিলো নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। উপার্জন করবেন। স্বাবলম্বী হবেন। কিন্তু টেলিমার্কেটিংয়ে নিজের ভবিষ্যত গড়বে— এমন ধারণা কখনই ছিলো না নাটোরের আলাইপুর উপজেলার বাসিন্দা ওয়াহিদা আহমেদের। অথচ সমাজতত্ত্বে স্নাতক ওয়াহিদা এখন দেশে বসেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে দিব্যি করে চলেছেন বিপণনের কাজ। আয়-রোজগারও ভালো। স্বাবলম্বী হয়ে নিজের খরচ মেটানোর পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদেরও হাত খরচা দিতে পারছেন তিনি। এতে তিনি যেমন খুশি, আনন্দিত পরিবারের অন্য সদস্যরাও। 

ওয়াহিদা আহমেদ রাজশাহীর বেসরকারি বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজতত্ত্বে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন। এখন টেলিমার্কেটিংকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। বিদেশে ক্রেতার কাছে ফোন করে নিজের কোম্পানির পণ্য বিপণনের কাজ করেন। এক বছরের বেশি সময় ধরে তিনি এই কাজ করছেন। 

টেলিমার্কেটিং হলো টেলিফোন, ইন্টারনেট বা ফ্যাক্স অথবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে সম্ভাব্য গ্রাহকদের কাছে পণ্য বা পরিষেবার সরাসরি বিপণন, যা টেলিমার্কেটারদের দ্বারা বা স্বয়ংক্রিয় কল (রোবোকল)-এর মাধ্যমে করা হয়। হাল আমলে এই বিপণনের পদ্ধতিটি বেশ জনপ্রিয়। 

সম্প্রতি এক আলাপচারিতায় ওয়াহিদা আহমেদ জানান, টেলিমার্কেটিং করে প্রতি মাসে গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা আয় করেন, আর তা দিয়ে বেশ ভালো চলে যায়। ভবিষ্যতে এ কাজে আরও ভালো করতে চান তিনি। 

জানা যায়, ওয়াহিদা আহমেদ প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের টেলিমার্কেটিং বিভাগের নাটোর সেন্টারে কাজ করেন। তিনি মূলত প্রাণ-আরএফএলের পণ্য কুয়েতের যেসব সুপারশপ বা দোকানিরা কেনেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। প্রতিদিন গড়ে ৮০টির মতো ফোনকল করতে হয় তাকে। 

এক প্রশ্নের উত্তরে ওয়াহিদা বলেন, ‘আমি মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে আমার কোম্পানির ক্লায়েন্টদের কল করি। ফোন করে তাদের সুপারশপ বা দোকানের মালিক বা প্রতিনিধিকে জিজ্ঞাসা করি, তার নতুন করে কোনো পণ্য লাগবে কি না। এ ছাড়া কোনো অভিযোগ থাকলেও এর সমাধানের চেষ্টা করি।’ 

আর কোনো নতুন পণ্যের ক্রয়াদেশ পেলে ওয়াহিদা আহমেদ তা প্রাণ-আরএফএলের নির্দিষ্ট সফটওয়্যারে সন্নিবেশিত করেন। প্রতিষ্ঠান সেই ফরমায়েশ অনুযায়ী নির্দিষ্ট ক্রেতার কাছে পণ্যের সরবরাহ করে। এভাবে তিনি কোম্পানির পণ্যের বিপণনে সহায়তা করেন।

ব্যবসায় বিপণন বা যোগাযোগ বিষয়ে না পড়েও এই পেশায় কেন আগ্রহী হলেন এমন প্রশ্নের উত্তরে ওয়াহিদা আহমেদ বলেন, এই পেশা নতুন ধরনের ও চ্যালেঞ্জিং। এটা আমার বেশ পছন্দের। যখন অফারটা পাই তখন আর না করিনি। আর আয়-রোজগারও ভালো। 

তিনি বলেন, ‘শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা এই পেশায় আসছেন। অনেকটা ঘরে বসেই এই পেশায় আয় করা যায়। বড় বড় শহরের বাইরে মফস্বলের শিক্ষিত তরুণ-তরণীরা আগ্রহী হলে এই পেশায় আসতে পারেন।’  

ওয়াহিদা জানান, বেতনের পাশাপাশি পণ্যের ক্রয়াদেশের ওপরও নির্দিষ্ট হারে অর্থ (কমিশন) পান তিনি।

প্রাণ-আরএফএল সূত্র জানায়, ওয়াহিদা আহমেদের মতো ঘরে বসেই দেশে-বিদেশে পণ্যের মার্কেটিং বা বিপণন পেশা হিসেবে নিয়েছেন প্রায় সাড়ে ৭শ’ নারী। যারা দেশের অন্যতম বড় শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানিতে কর্মরত রয়েছেন। কোম্পানির টেলিমার্কেটিং খাতে কর্মরত তরুণীরা মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশের ছোট-বড় সুপারশপের মালিকদের ফোন দিয়ে বাংলাদেশের পণ্যের কথা বলেন এবং ক্রয়াদেশ দেন। সেই অনুযায়ী আমদানিকারককে বিষয়টি কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ে সেইসব পণ্য সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এভাবেই দেশে-বিদেশ টেলিমার্কেটিংয়ের কাজ করছেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা।

নারীদের সম্পৃক্ত করে টেলিফোনের মাধ্যমে বিশ্ববাজারে বিপণন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২০২৪ সালে টেলিমার্কেটিং ধারণা নিয়ে প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। শুরুতে বিভিন্ন দেশের পরিবেশক ও খুচরা বিক্রেতার তথ্যসংবলিত একটি সফটওয়্যার তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি। শুরুতে মাত্র চার নারী কর্মী নিয়োগ দিয়ে নাটোরে একটি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ সূত্রে জানা যায়, নাটোর ও রাজশাহী অঞ্চলে তিনটি সেন্টারে বর্তমানে প্রায় ৭৫০ নারী কর্মী টেলিমার্কেটিংয়ের কাজ করছেন। যারা প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পণ্য বিশ্ববাজারে ক্রেতার সামনে তুলে ধরছেন। নিয়োগ পাওয়া নারী কর্মীরা ভালো করায় এ খাত নিয়ে আরও বড় স্বপ্ন দেখছে শিল্প গ্রুপটি। এ জন্য টেলিমার্কেটিং খাতে ২০২৭ সালের মধ্যে পাঁচ হাজার নারী কর্মী নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সিলেট, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা অঞ্চলে টেলিমার্কেটিং সেন্টার তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

টেলিমার্কেটিংয়ের যাত্রা নিয়ে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, সশরীর বিপণন কার্যক্রম পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি অনেক ব্যয়বহুল। টেলিফোন কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি জায়গায় বসে বিদেশে যোগাযোগ সম্ভব। এ ক্ষেত্রে নারীদের যদি প্রশিক্ষণ দিয়ে নিজ এলাকায় কাজের সুযোগ দেওয়া যায়, তবে তারা যেমন স্বাবলম্বী হবেন তেমনই অনেক বেশি অনুপ্রাণিত হবেন। সেই চিন্তা থেকেই মূলত নারী কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করে টেলিমার্কেটিং খাতের চিন্তা আসে।

কীভাবে কাজটি করা হয়— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, প্রথমেই প্রাণ-আরএফএলের পণ্য বিদেশের যেসব সুপারশপ বা দোকানে রাখা হয়, সেসব সুপারশপের মালিককে ফোন করেন টেলিমার্কেটিংয়ে যুক্ত থাকা নারীরা। নির্দিষ্ট পণ্যটি কেমন বেচাকেনা চলছে, চাহিদা কেমন, বিক্রেতা খুশি কি না, এসব জিজ্ঞাসা করে পণ্যের গুণগত মান সম্পর্কে জানান ওই কর্মী। পরে তার (মালিক) কাছ থেকে সম্ভাব্য ক্রয়াদেশ নেন। এরপর প্রাণ-আরএফএলের নির্দিষ্ট সফটওয়্যার সেই ক্রয়াদেশের তথ্য দেয়। এরপর ওই তথ্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় ওই নির্দিষ্ট দেশের প্রাণ-আরএফএলের পণ্য আমদানিকারককে। ওই আমদানিকারক তার চালানে ওই নির্দিষ্ট পরিমাণ অন্তর্ভুক্ত করেন। এভাবে চলে টেলিমার্কেটিংয়ের কাজ।

প্রাণ-আরএফএলের টেলিমার্কেটিং খাতের হেড অব অপারেশন মোহাম্মদ তানবীর হোসেন বলেন, ‘আমাদের টেলিমার্কেটিং খাতে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেই ভাষাগত দক্ষতা দিয়ে কাজের সুযোগ পাচ্ছেন। অনেকেই আছেন যারা স্নাতক শেষ করেও ঢুকছেন। এখানে আয়ের খুব ভালো সুযোগ রয়েছে। এটি একটি সম্ভাবনাময় খাত।’ 

নতুনদের টেলিমার্কেটিং পেশায় আসার বিষয়ে ওয়াহিদার পরামর্শ, পেশাটি বেশ মজার।  এক্ষেত্রে নতুনদের বলবো টেলিমার্কেটিংয়ে কাজ করতে চাইলে ইংরেজিতে ভালো করতে হবে। সুন্দরভাবে গুছিয়ে কথা বলতে হবে। এভাবে নিজেকে প্রস্তুত করলেই টেলিমার্কেটিংয়ে সফল হওয়া সম্ভব।