শিরোনাম
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : হাফিজা খাতুন। বয়স আনুমানিক ৫২ বছর। স্বামী আকমল হোসেন একটি এনজিওতে কাজ করে। বাড়ি সিরাজগঞ্জ সদর উপাজেলার মাছুমপুর গ্রামে। স্বামীর নামের সাথে মিল রেখে নাম রাখে হাফিজা আকমল। করোনার সময় স্বামীর চাকরি চলে যায়। সংসারে নেমে আসে অভাব আর কষ্ট। অভাব-অনটনে সংসার ঠিকমতো চলে না। স্বামীর সাথে মাঝে-মধ্যেই তার ঝগড়া বেঁধে যায়। স্বামী তাকে অমানুষিক নির্যাতন আরম্ভ করে। মান-সম্মানের ভয়ে কাউকে কিছু বলে না সে। নীরবে সহ্য করে যায় সকল নির্যাতন-যন্ত্রণা।
আমাদের দেশে নারীরা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। শারীরিক নির্যাতন, যৌতুক, এসিড নিক্ষেপ, পাঁচার, খুন বা হত্যার মতো ঘটনা রয়েছে। জীবনসঙ্গী বা স্বামীর মাধ্যমে সহিংসতার মাত্রা বেশি হলেও ভুক্তভোগী নারীরা তাদের সাথে ঘটে যাওয়া সহিংসতার কথা কাউকে কখনো বলে না।
নারী ও শিশু নির্যাতন জঘন্য একটি অপরাধ। বৈষম্যমূলক সমাজ কাঠামোর ভিতরে দেশের নারীরা নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কর্মস্থলে বৈষম্য ও হয়রানির শিকার হচ্ছে, ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে কিশোরীদের কেউ কেউ আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে।
নারী ও কিশোরীদের অপহরণ করা হচ্ছে, তাদের সীমান্ত পার করে বিদেশে পাঁচার করা হচ্ছে। এ ধরনের নির্যাতনের ফলে নারীর শারীরিক ও মানষিক ক্ষতি হয় এবং তার স্বাভাবিক জীবন যাত্রা বিঘ্নিত হয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) যৌথভাবে জরিপ পরিচালনা করে। এই খানাভিত্তিক জরিপে শহর, গ্রাম, দুর্যোগপ্রবণ, বস্তি এলাকাসহ ২৭ হাজার ৪৭৬ জন নারীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
এতে দেখা যায়, ৭০ শতাংশ নারী তাদের জীবদ্দশায় অন্তত একবার হলেও সহিংসতার শিকার হন। ২০১৫ সালে এই হার ছিল ৭৩ শতাংশ। এ সহিংসতা হতে পারে শারিরীক, যৌন, মানসিক ও অর্থনৈতিক। ২০২৪ সালে ৪৯ শতাংশ নারীর ওপর এ ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। পরিবারের অন্য সদস্যদের তুলনায় স্বামীর মাধ্যমে বেশি নির্যাতনের শিকার হন নারীরা।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে অর্থনীতির সকল সূচকে, মানবিক ও সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্যের পেছনে নারীদের ভূূমিকা ও অবদান অবিস্বরণীয়। দেশের কৃষি, গ্রামীন অর্থনীতি, পোশাক শিল্প, উন্নয়ন, অগ্রগতিসহ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থানের ঈর্ষণীয় সাফল্যেও ক্ষেত্রেও নারীরা রেখেছেন অনন্য অবদান।
কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্য, নারীদের সর্বত্র সাহসী বিচরণ সত্বেও নারী ও শিশুর ওপর নির্যাতন, সহিংসতার ঘটনায় নারীর অগ্রযাত্রা যেন কুসুমাস্তীর্ন না হয়ে পদে পদে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঘরে, বাইরে মর্যাদার জায়গায় নারীর অবস্থান আশানুরূপ ভাবে পাল্টায়নি; পাল্টায়নি নারীর প্রতি এক শ্রেণীর মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। এ কারণেই, দুই বছরের শিশু থেকে বৃদ্ধা নারী সবাই শিকার হচ্ছে সহিংসতার।
নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে দেশে বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। যেমন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩); যৌতুক নিরোধ আইন, ১৯৮০; অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন, ২০০২; ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন, ২০০৯; পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২; মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ এবং পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন-২০১০ প্রভৃতি।
বাংলাদেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ১৯৮৩ সালে প্রথম প্রণীত হয় নারী নির্যাতন (নিম্নতম শাস্তি) অধ্যাদেশ ১৯৮৩ (১৯৮৩ সালের ৬০ নম্বর অধ্যাদেশ)। অন্যান্য আইনের ওপর প্রাধান্য দিয়ে প্রণীত এই আইনটিতে নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিতকরণ ও এর শাস্তি নির্ধারন করার বিধান আছে। এছাড়া ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ছাড়াও বখাটেদের উৎপাতের জন্য দণ্ডবিধি আইন প্রচলিত আছে।
প্রচলিত আইনে বখাটেদের যে শাস্তির বিধান আছে তা হলো- ঢাকা মহানগর পুলিশ আইনের ৭৬ ধারা ও দন্ডবিধির ৫০৯ ধারা অনুযায়ী এ অপরাধের জন্য এক বছরের কারাদণ্ডসহ দুই হাজার টাকা জরিমানার বিধান আছে এবং নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ১০ নম্বর ধারায় যৌন নিপীড়ন ও শ্লীলতাহানির জন্য ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়ার বিধান আছে।
অনেক সময় সচেতনতার অভাবে, আবার কখনও কখনও লোকলজ্জার ভয়ে, কখনো অর্থাভাবে, কখনও প্রতিপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় আইনি প্রতিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দেখা দেয়।
আইন সম্পর্কে ধারনা ও সচেতনতার অভাবে নারীরা অনেক ক্ষেত্রে অধিকার পাচ্ছে না। বিশেষ করে রাস্তা ঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা কর্মস্থানে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে বিধিমালা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
মূলত আইন বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে অনেক নারী প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হলেও পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরক্ষা ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০-এর কাছে যাচ্ছে না। আবার এ আইনের কয়েকটি ধারায় অভিযোগ প্রমাণ করতে গেলে সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীকেই ভোগান্তি পোহাতে হয়।
তাই, অনেকে জানলেও মামলা করেন না। এ আইন সম্পর্কে আদালত সংশ্নিষ্টদের মধ্যেও সচেতনতার অভাব রয়েছে। অথচ আইনটি নারীর একটি শক্তিশালী রক্ষাকবচ হতে পারত।
আইন সম্পর্কে প্রচারের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকার পাশাপাশি সরকার, বিচার বিভাগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, জনপ্রতিনিধি, এনজিও, সুশীল সমাজসহ সংশ্লিষ্টদের আরো দায়িত্বশীল ভূমিকাই পারে ঘরে-বাইরে নারী, শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। এই নির্যাতন অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সমাজে বসবাসরত সকল শ্রেণীর মানুষকে সচেতন করতে হবে।
নারীর প্রতি সহিংসতা দেশটিতে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করছে, নারীর ওপর নিপীড়নকে উৎসাহিত করছে এবং নারীর সহিংসতার অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশ তার সাড়ে সাত কোটি নারী ও কন্যাশিশুর জন্য অনুকুল পরিবেশে সৃষ্টি করতে পারে, যাতে তারা দেশের সামগ্রিক উন্নতিতে অবদান রাখতে পারে।