বাসস
  ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ২২:২৯

সমৃদ্ধ প্রজন্ম তৈরিতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর আহ্বান

ছবি : বাসস

ঢাকা, ২৯ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত আজ এক অনুষ্ঠানে বক্তারা সমৃদ্ধ প্রজন্ম তৈরিতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে বলেছেন,  দুর্নীতি ও অপচয় রোধ করে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। শিক্ষার মানোন্নয়নের মাধ্যমে দুর্নীতি ও অপচয়ের মতো সংকট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।

তারা বলেন, ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ জিডিপির অন্তত ৪ শতাংশে উন্নীত করা উচিত। 
বিগত বছরগুলোতে জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ আন্তর্জাতিক ও জাতীয় প্রত্যাশার তুলনায় যথেষ্ট কম ছিল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

আজ মঙ্গলবার সামাজিক সংগঠন নাগরিক বিকাশ ও কল্যাণ (নাবিক) আয়োজিত ‘জনবান্ধব বাজেট ভাবনা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন।

দিনব্যাপি অনুষ্ঠানের  চার পর্বে শিশু, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও তারুণ্যের বাজেট বিষয়ক আলোচনায় অংশ নেন বিশিষ্টজনেরা।  অনুষ্ঠানেরসহ আয়োজক ছিল বাংলাদেশ কো-ক্রিয়েশন ও হ্যাপি ভেঞ্চারস।

শিক্ষা বাজেট আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান। আলোচকদের মধ্যে ছিলেন মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুর রব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মমিনুর রশিদ ও জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া।

স্বাস্থ্য বিষয়ক বাজেট সেশনে সভাপতিত্ব করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা, স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক। ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ।

নাবিক সহ-সভাপতি বুরহান উদ্দিন ফয়সলের সঞ্চালনায় স্বাস্থ্য আলোচনায় অংশ নেন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক ড. মো. এনামুল হক, এবি পার্টির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. মেজর (অব.) আব্দুল ওহাব মিনার, রক্ত রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মনজুর মোরশেদ, পাবলিক হেলথ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এর প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট আবু জামিল ফয়সাল, বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের (বিএইচআরএফ) সভাপতি রাশেদ রাব্বি, জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. মো. জহিরুল ইসলাম।

তারুণ্যের বাজেট আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. তারিকুল ইসলাম। বক্তব্য দেন পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান, এবি পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার জুবায়ের আহমেদ ভুইয়া, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, এনএলআই সিকিউরিটিজে লিমিটেডের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার রেদওয়ান হোসেন, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) মহাসচিব মোমিনুল আমিন, রাজনৈতিক বিশ্লেষক রেজাউল করিম রনি, নাবিক সভাপতি ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার, লেখক ও গবেষক জাকারিয়া পলাশ।

শিক্ষা খাতের বাজেটে মূল প্রবন্ধে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় সহকারী অধ্যাপক ও শিক্ষা প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মো. সাব্বির হোসেন বলেন, বিগত বছরগুলোতে আমাদের জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ আন্তর্জাতিক ও জাতীয় প্রত্যাশার তুলনায় যথেষ্ট পিছিয়ে আছে। ইউনেস্কো ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একটি দেশের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হওয়া উচিত মোট জিডিপির ৪-৬ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও এই বরাদ্দ ২-২.৫ শতাংশের মধ্যেই ঘোরাফেরা করছে। ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে আমরা আশা করব, শিক্ষাখাতে বরাদ্দ অন্তত জিডিপির ৪ শতাংশে উন্নীত করা হোক।

স্বাস্থ্য বাজেটের আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, সবার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আলোকে এ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। রোগ প্রতিরোধে গুরুত্ব বাড়াতে হবে। এটি ছাড়া নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব না।

প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বরাদ্দের তুলনা  করে তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ একদম তলানিতে রয়েছে। গত বছর স্বাস্থ্যে মোট বাজেটের ৫ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছিল, যা জিডিপির ০.৪৭% ছিল। আগেরবারও এমন ছিল।  ২০২২-২৩ এ প্রস্তাব ছিল ৩৬ হাজার কোটির বেশি, ষান্মাসিক পর্যালোচনার সময় কমিয়ে  ২৯ হাজার সাতশ’ কোটি করা হয়। এ বছর ব্যয় হয় ২২ হাজার ৬০০ কোটির মতো। আমাদের বুঝতে হবে এটি কেন ব্যয় করতে পারছি না।

তিনি বলেন, যদি পুরোটা ব্যয় করা যায়, তাহলে তিনগুণ বেশি কাজ করা যাবে। কিন্তু দুর্নীতির কারণে সম্ভব হয়নি। আরেকটি হচ্ছে সকল চিকিৎসকের সমানভাবে দায়িত্ব পালন নিশ্চিত না করতে পারা।

হাসপাতাল একটি জটিল প্রতিষ্ঠান। নীতিনির্ধারকদের এই ক্ষেত্রে বোঝার ঘাটতি আছে। এটি জনসম্পদের অপচয়। আমাদের রিসোর্সগুলোকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে হবে। একইসাথে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে হবে। আধুনিক কোনো ফ্যাসিলিটিজ গড়ে তোলা হয়নি। আধুনিক মেডিকেল স্টোরেজ নাই। ৫৪ বছরে এই আর্কিটেকচারাল ডিজাইনই করা যায়নি।

এসব সমস্যার সমাধানে একাধিক পরামর্শ তুলে ধরে তিনি বলেন, রুরাল হেলথ সিস্টেমের তিনটি এপিসেন্টারকে ইউটিলাইজ করে একটি সেন্টারে পরিণত করতে হবে। সবার জন্য হেলথ কার্ড দিতে হবে। ন্যাশনাল হেলথ ফান্ড গঠন করতে হবে।

এবি পার্টির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. মেজর (অব.) আব্দুল ওহাব মিনার বলেন, স্বাস্থ্য হলো টেকনিক্যাল বিষয়। সাধারণ মানুষ এগুলো বোঝে না।  এক সময় মানুষ টিকা নিতো না। এখন সে প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে ইপিআই কর্মসূচি সফল হয়েছে। স্বাস্থ্য প্রশাসনকে বুঝতে হবে। যারা ক্ষমতার চেয়ারে বসে, তাদের প্রথম টার্গেট থাকে এই চেয়ারে কতদিন থাকা যায়। এ থেকে কীভাবে উত্তরণ হবে?

ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গু জরিপের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এ জরিপগুলো সত্য নয়। এ রোগগুলো প্রিভেন্ট করতে উদ্যোগ নিতে হবে। ২.৫ মিলিয়ন ড্রাগ এডিক্টস বাংলাদেশে। এদের ৮০ ভাগই ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী।

স্বাস্থ্যে বরাদ্দের চেয়ে তা বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন অধ্যাপক আবদুল ওহাব মিনার। তিনি বলেন, ‘বাজেট বেশি রেখে লাভ নাই, বালতির তলা ছিদ্র করে বের করে দিবে। যে বাংলাদেশ তৈরি করতে চায় তা প্রস্তুত, কিন্তু আমরা প্রস্তুত না।

সভাপতির বক্তব্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা, স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, সব জায়গার মতো স্বাস্থ্যেও ঘাটতি আছে। স্বাস্থ্যবান জাতিই উন্নত জাতি। স্বাস্থ্যবান জাতি না হলে উন্নত জাতি হতে পারবেন না। তিনি বলেন, জনবান্ধব স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য দরকার বাজেট। প্রয়োজনটা যেন মেটানো যায়। কিন্তু শুধু বাজেট থাকলেই স্বাস্থ্যের মান বাড়বে না।

ডব্লিউএইচওর সাবেক এই আঞ্চলিক উপদেষ্টা বলেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মানোন্নয়ন হচ্ছে না, তার কারণ স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি। আরেকটি হলো অপচয়, যেখানে যা ব্যয় হওয়ার কথা সেখানে হচ্ছে না। এজন্য মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীদের অদক্ষতাও একটি কারণ। তিনি বলেন, মানুষের চিকিৎসায় বড় অংশ নিজের পকেট থেকে ব্যয় করে, যা প্রায় আফ্রিকার দেশগুলোর সমান। চিকিৎসা শিক্ষার মান সর্বকালের সর্বনিম্নে। চিকিৎসা সেবার মানও একই। শিক্ষার মানোন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার মান বাড়াতে পারলে সেবার মান বাড়াতে পারব।

এ সময় স্কুলের পাঠ্যক্রমে স্বাস্থ্যশিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এটি করা গেলে সবাই উপকৃত হবে।

শিশুদের জন্য অন্তত ২০ শতাংশ বাজেট রাখার দাবি এর আগে সকালে  প্রথম সেশনে শিশুবান্ধব বাজেট আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। শিশুবান্ধব বাজেট সেশনে সভাপতিত্ব করেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার। ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ, শিশুর প্রতি বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা জাফর সাদিক। আলোচক ছিলেন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ও শিশু বিষয়ক সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামসুদ্দীন, এবি পার্টির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার নাসরিন সুলতানা মিলি, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক, শিশু সংগঠক জাকারিয়া হাবিব পাইলট, বাংলাদেশ ডায়ালগের পরিচালক আসলাম বেগ সায়েম, টুইম্বলের প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তা শামীম আশরাফ ও কিডস টাইমের কো-ফাউন্ডার তাহমিনা রহমান সাথী। 
সঞ্চালক ছিলেন নাবিকের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ হাসান।