বাসস
  ২০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৭

সৌম্যর দুর্দান্ত সেঞ্চুরির পরও নিউজিল্যান্ডের কাছে সিরিজ হারলো বাংলাদেশ

নেলসন, ২০ ডিসেম্বর, ২০২৩ (বাসস) : ওপেনার সৌম্য সরকারের দুর্দান্ত সেঞ্চুরির পরও এক ম্যাচ বাকী থাকতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ হারলো সফরকারী বাংলাদেশ ক্রিকেট দল । আজ সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে নিউজিল্যান্ডের কাছে ৭ উইকেটে হেরেছে টাইগাররা। প্রথম ম্যাচ বৃষ্টি আইনে ৪৪ রানে হেরেছিলো বাংলাদেশ। সিরিজ হার নিশ্চিতের পাশাপাশি ২-০ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়লো বাংলাদেশ।
এ ম্যাচে ১৫১ বলে ২২টি চার ও ২টি ছক্কায় ১৬৯ রানের অসাধারন ইনিংস খেলেন সৌম্য। তার দেড়শ রানের ইনিংসের সুবাদে প্রথমে ব্যাট করে ৪৯ দশমিক ৫ ওভারে সব উইকেট হারিয়ে ২৯১ রান করে বাংলাদেশ। জবাবে ২২ বল বাকী রেখে ৩ উইকেটে ২৯৬ রান তুলে ম্যাচ ও সিরিজ জয় নিশ্চিত করে নিউজিল্যান্ড। কিউইদের পক্ষে হেনরি নিকোলস ৯৫ ও উইল ইয়ং ৮৯ রান করেন। দল হারলে এ ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশের  সৌম্য।
নেলসনে টস জিতে প্রথমে বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রন জানায় নিউজিল্যান্ড। ব্যাটিং শুরু করে প্রথম ৪ ওভারে বিনা উইকেটে ১১ রান তুলে সাবধানে এগোতে থাকেন বাংলাদেশের দুই ওপেনার সৌম্য ও এনামুল  হক বিজয়।  পঞ্চম ওভারে পেসার এডাম মিলনের প্রথম বলে খোঁচা মেরে ম্লিপে টম লাথামকে ক্যাচ দেন ২ রান করা বিজয়।
বিজয় ফেরার পরও  রানের চাকা সচল রাখেন সৌম্য। সপ্তম ওভারে ও’রুর্কের  বলে তিনটি চার মারেন তিনি। পরের ওভারে জ্যাক ডাফির বলে কভারে হেনরি নিকোলসকে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন ১টি চারে ৬ রান করা বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত।
শান্তর বিদায়ে উইকেটে এসে ডাফির দ্বিতীয় শিকার হন লিটন দাস। কভার পয়েন্টে উইল ইয়ংকে ক্যাচ দেন ১টি চারে ৬ রান করা লিটন। দশম ওভারে ৪৪ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে বাংলাদেশ।
এ অবস্থায় তাওহিদ হৃদয় (১৬স বলে ১২ রান) রান আউট হলে চাপ আরও বেড়ে যায় বাংলাদেশের। 
দলীয় ৮০ রানে চতুর্থ উইকেট পতনের পর ক্রিজে সৌম্যর সঙ্গী হন অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহিম। ২১তম ওভারে চার মেরে ৫৮ বলে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ১২তম হাফ-সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন সৌম্য। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে সর্বশেষ হাফ-সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। 
হাফ-সেঞ্চুরিতে পা দেওয়ার ওভারে দু’বার জীবন পান সৌম্য। ওভারের তৃতীয় বলে পেসার জশ ক্লার্কসনের বলে মিড অফে ক্যাচ ফেলেন রাচিন রবীন্দ্র। পঞ্চম বলে লেগ বিফোর আউট হন সৌম্য। কিন্তু  রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি।
সৌম্যর হাফ-সেঞ্চুরিতে ২৩তম ওভারে ১শতে পৌঁছায় বাংলাদেশের রান। ৩০তম ওভারে দেড়শ রান স্পর্শ টাইগাররা। ততক্ষণে আশির ঘরে পৌঁছে যান সৌম্য।
৩৫তম ওভারে ভাঙ্গে সৌম্য-মুশফিকের জমে যাওয়া জুটি। ডাফির বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন ৫টি বাউন্ডারিতে ৫৭ বলে ৪৫ রান করা মুশফিক। পঞ্চম উইকেটে ১০৮ বলে ৯১ রান যোগ করেন সৌম্য-মুশফিক। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে কিউইদের বিপক্ষে পঞ্চম উইকেটে এটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানের জুটি।
মুশফিক ফেরার পর সেঞ্চুরির পথে হাঁটতে থাকেন সৌম্য। ৩৭তম ওভারের তৃতীয় বলে ব্যক্তিগত ৯২ রানে ইনিংসে তৃতীয়বারের মত জীবন পান তিনি। ও’রুর্কের  বলে কভার পয়েন্টে সৌম্যর ক্যাচ ফেলেন ইয়ং।
তিনবার জীবন পেয়ে অবশেষে ৪০তম ওভারের প্রথম বলে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৬৫তম ম্যাচে তৃতীয় সেঞ্চুরি করেন সৌম্য। ১৩টি চারে ১১৬ বল খেলে তিন অংকে পা রাখেন তিনি। ২০১৮ সালের অক্টোবরে চট্টগ্রামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সর্বশেষ সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। এরপর ২৬ ইনিংসে কোন সেঞ্চুরি পাননি আগের ওয়ানডেতে শূণ্যতে ফেরা সৌম্য। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে এটি বাংলাদেশের ব্যাটারদের চতুর্থ শতক।
১৬ ম্যাচ পর ওয়ানডেতে বাংলাদেশের কোন ওপেনারের সেঞ্চুরি এটি। সর্বশেষ এশিয়া কাপে লাহোরে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন মেহেদি হাসান মিরাজ।
সেঞ্চুরি পর সৌম্যর বড় ইনিংস খেলার পথে সঙ্গ দেন মিরাজ ও তানজিদ হাসান সাকিব। ষষ্ঠ উইকেটে মিরাজকে নিয়ে ৫৩ বলে ৬১ রান ও সপ্তম উইকেটে তানজিমের সাথে ২৬ বলে ৪০ রান যোগ করেন সৌম্য। মিরাজ ২৬ বলে ১৯ ও তানজিম ১১ বলে ১৩ রানে ফিরলেও ৪৭তম ওভারের শেষ বলে চার মেরে নিজের দেড়শ রান পূর্ণ করেন সৌম্য। বাংলাদেশের তৃতীয় ব্যাটার হিসেবে দেড়শ রান করতে ১৪৪ বল খেলেছেন তিনি। এর আগে তামিম ইকবাল দু’বার (১৫৪ ও ১৫৮) এবং লিটন দাস (১৭৬) একবার দেড়শ রানের ইনিংস খেলেছিলেন।  
ইনিংসে ৪৯তম ওভারে ১৭ রান পায় বাংলাদেশ। এই ওভারে সৌম্য ১টি করে চার-ছক্কা ও অভিষিক্ত রিশাদ হোসেন ১টি ছক্কা মারেন। শেষ ওভারের প্রথম বলে সমাপ্তি ঘটে সৌম্যর ইনিংসের। ও’রুর্কের  বলে নিকোলসকে ক্যাচ দেন ২২টি চার ও ২টি ছক্কায় ১৫১ বলে ১৬৯ রানের নান্দনিক ইনিংস খেলে আউট হন সৌম্য।
এই ইনিংসের সুবাদে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসের  মালিক এখন সৌম্য। ২০১৫ সালে আগের সর্বোচ্চ অপরাজিত ১২৮ রানের ইনিংস খেলেছিলেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। এছাড়া এশিয়ান ব্যাটারদের মধ্যে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডও গড়েছেন সৌম্য। আগের রেকর্ডটি ছিল ভারতের শচীন টেন্ডুলকারের। ২০০৯ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬৩ রানে অপরাজিত ইনিংস খেলেছিলেন টেন্ডুলকার।
সৌম্যর অসাধারন সেঞ্চুরির ইনিংসে সুবাদে ৪৯ দশমিক ৫ ওভারে সব উইকেট হারিয়ে ২৯১ রানের বড় সংগ্রহ পায় বাংলাদেশ। নিউজিল্যান্ডের ডাফি ও ও’রুর্ক ৩টি করে উইকেট নেন।
২৯২ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে ভালো সূচনা করেন নিউজিল্যান্ডের দুই ওপেনার ইয়ং ও রবীন্দ্র। ৬৬ বলে ৭৬ রান যোগ করেন তারা। রিশাদের দারুন ক্যাচে মারমুখী ব্যাট করা রবীন্দ্রকে শিকার করে বাংলাদেশকে প্রথম বেক-থ্রু এনে দেন পেসার হাসান মাহমুদ। ৭টি চার ও ১টি ছক্কায় ৩৩ বলে ৪৫ রান করেন রবীন্দ্র।
এরপর হেনরি নিকোলসকে নিয়ে বাংলাদেশ বোলারদের সামনে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন ইয়ং। ৫১ বলে অষ্টম হাফ-সেঞ্চুরি তুলে নেন প্রথম ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি করা ইয়ং। অর্ধশতকের পর নিকোলসকে নিয়ে সহজেই দলের রানের চাকা ঘুড়াচ্ছিলেন তিনি। ২৭তম ওভারে ইয়ংকে থামানোর উপলক্ষ্য তৈরি করেছিলেন পেসার শরিফুল ইসলাম। কিন্তু ৭৭ রানে থাকা ইংয়ের ক্যাচ ফেলেন হৃদয়।
জীবন পাওয়া ইয়ংকে টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরি করতে দেননি বাংলাদেশের হাসান। ৩৩তম ওভারে নিজের বলে ফিরতি ক্যাচ নিয়ে ইয়ংকে বিদায় করেন হাসান। ৮টি চার ও ২টি ছক্কায় ৯৪ বলে ৮৯ রান করেন ইয়ং। দ্বিতীয় উইকেটে নিকোলসের সাথে ১৩১ বলে ১২৮ রান তুলে নিউজিল্যান্ডকে জয়ের পথে রেখে ফিরেন ইয়ং।
২০৪ রানে ইয়ংকে শিকার করে বাংলাদেশকে ম্যাচে ফেরার পথ দেখান হাসান। এরপর লাথামকে নিয়ে ৪৭ বলে ৫৬ রান যোগ করে কিউইদের জয়ের পথকে সহজ করেন নিকোলস। শরিফুলের  মিকার হওয়ার আগে  ৯৯ বলে ৮টি চার ও ১টি ছক্কায় ৯৫ রান করেন নিকোলস। চতুর্থ উইকেটে ৩৪ বলে অবিচ্ছিন্ন ৩৬ রান করে ২২ বল বাকী থাকতে নিউজিল্যান্ডকে জয়ের স্বাদ দেন লাথাম ও ব্লান্ডেল। লাথাম ৩৪ ও ব্লান্ডেল ২৪ রানে অপরাজিত থাকেন। বাংলাদেশের হাসান ২টি ও শরিফুল ১টি উইকেট নেন।
আগামী ২৩ ডিসেম্বর নেপিয়ারে সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডে খেলতে নামবে বাংলাদেশ ও নিউজিল্যান্ড।
স্কোর কার্ড : (টস-নিউজিল্যান্ড)
বাংলাদেশ ইনিংস :
সৌম্য ক নিকোলস ব ও’রুর্ক ১৬৯
আনামুল ক লাথাম ব মিলনে ২
শান্ত ক নিকোলস ব ডাফি ৬
লিটন ক ইয়ং ব ডাফি ৬
হৃদয় রান আউট ১২
মুশফিকুর ক ব্লান্ডেল ব ডাফি ৪৫
মিরাজ ক ইয়ং ব অশোক ১৯
তানজিম ক অশোক ব ক্লার্কসন ১৩
রিশাদ ক ব্লান্ডেল ব ও’রুর্ক ৬
শরিফুল অপরাাজিত ১
হাসান ব ও’রুর্ক ০
অতিরিক্ত (বা-১, লে বা-৬, ও-৫) ১২
মোট (অলআউট, ৪৯.৫) ২৯১
উইকেট পতন : ১-১১ (বিজয়), ২-৩৬ (শান্ত), ৩-৪৪ (লিটন), ৪-৮০ (হৃদয়), ৫-১৭১ (মুশফিকুর), ৬-২৩২ (মিরাজ), ৭-২৭২ (তানজিম), ৮-২৯০ (সৌম্য), ৯-২৯১ (রিশাদ), ১০-২৯১ (হাসান)।
নিউজিল্যান্ড বোলিং :
মিলনে : ১০-০-৭৪-১ (ও-১),
ডাফি : ১০-০-৫১-৩ (ও-১),
ও’রুর্ক: ৯.৫-০-৪৭-৩ (ও-১),
ক্লার্কসন: ৬-০-৩০-১ (ও-২),
অশোক : ১০-১-৬৩-১
রবীন্দ্র : ৪-০-১৯-০।
নিউজিল্যান্ড ইনিংস :
ইয়ং ক এন্ড ব হাসান ৮৯
রবীন্দ্র ক রিশাদ ব হাসান ৪৫
নিকোলস ক রিশাদ ব শরিফুল ৯৫
লাথাম অপরাজিত ৩৪
ব্লান্ডেল অপরাজিত ২৪
অতিরিক্ত (লে বা-২, ও-৭) ৯
মোট (৩ উইকেট, ৪৬.২ ওভার) ২৯৬
উইকেট পতন : ১-৭৬ (রবীন্দ্র), ২-২০৪ (ইয়ং), ৩-২৬০ (নিকোলস)।
বাংলাদেশ বোলিং :
শরিফুল : ৯-১-৪৯-১ (ও-২),
হাসান : ৭-০-৫৭-২ (ও-১),
তানজিম : ৬-০-৫১-০,
মিরাজ : ১০-১-৪৫-০ (ও-২),
রিশাদ : ৯.২-০-৬২-০,
শান্ত : ৫-০-৩০-০ (ও-২)।
ফল : নিউজিল্যান্ড ৭ উইকেটে জয়ী।
ম্যাচ সেরা : সৌম্য সরকার (বাংলাদেশ)।
সিরিজ : তিন ম্যাচ সিরিজে ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে নিউজিল্যান্ড।