শিরোনাম
ঢাকা, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ (বাসস) : বিশ্বকাপের বছর হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই বিশ্ব ফুটবলে ২০২২ সাল একটি অন্যরকম বছর হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। কিন্তু ২০২৩ সালও তার তুলনায় পিছিয়ে থাকেনি। নানা ঘটনায় সারা বছর জুড়েই বিশ্ব ফুটবলে আলোচনা-সমালোচনা লেগেই ছিল।
নতুন বছরের প্রাক্কালে ফুটবলের শীর্ষ ১০ মুহূর্ত এখানে তুলে ধরা হলো :
১.ম্যানচেস্টা সিটির চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় :
জুনে ফাইনালে ইন্টার মিলানকে ১-০ গোলে পরাজিত করে শেষ পর্যন্ত ম্যানচেস্টার সিটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা জয়ের কৃতিত্ব দেখায়। বহুল প্রতিক্ষীত এই ট্রফিটি কোচ পেপ গার্দিওলার সিটি ক্যারিয়ারে প্রাপ্য ছিল। এর আগে বার্সেলোনার হয়ে দুটি শিরোপা জয়ের পর স্প্যানিয়ার্ড গার্দিওলার কোচিং ক্যারিয়ারে এটি তৃতীয় চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা। কিন্তু সিটির হয়ে ইউরোপীয়ান সর্বোচ্চ এই ক্লাব প্রতিযোগিতার শিরোপা জয়ের কৃতিত্ব গার্দিওলাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এই শিরোপার মাধ্যমে সিটি প্রথমবারের মত ট্রেবল জয়ের সাফল্য লাভ করে। টানা তৃতীয় লিগ শিরোপা ও এএফ কাপও তারা জয় করেছে এ বছরই। এ বছর তাদের মুকুটে আরো দুটি পালক যোগ হয়েছে, উয়েফা সুপার কাপ ও ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ।
২. ওশিমেনের নৈপুন্যে নাপোলির সিরি-এ জয়
গত মৌসুমে সিরি-এ লিগে নাপোলির হয়ে ভিক্টর ওশিমেন সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড গড়েছেন। নাইজেরিয়ান এই স্ট্রাইকারের নৈপুন্যে ইতালিয়ান শীর্ষ লিগে নাপোলি ৩৩ বছর পর শিরোপা জয়ের কৃতিত্ব দেখায়। ক্যারিয়ার সেরা ২৬ গোল করে ওশিমেন শুধুমাত্র নাপোলিকে শিরোপা উপহার দেননি, বরং নিজেকে ইউরোপের শীর্ষ ক্লাবগুলোর আগ্রহে পরিণত করেছেন। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ল্যাজিওর চেয়ে ১৬ পয়েন্ট এগিয়ে নাপোলি শীর্ষস্থান দখল করে। দাপটের সাথে ইতালিয়ান লিগের এই বিজয়ী সারা বছরই নাপোলিকে অন্য রকম এক আত্মবিশ্বাস যুগিয়েছে।
৩. মেসির অষ্টম ব্যালন ডি’র জয়
পিএসজি ছেড়ে লিওনেল মেসির আমেরিকার মেজর লিগ সকারের ইন্টার মিয়ামিতে যোগদান অনেকেই ভাল চোখে দেখেনি। কিন্তু বিশ্বসেরা এই তারকা ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায় শুধুমাত্র ফুটবলকে উপভোগের জন্যই মিয়ামিতে পাড়ি জমিয়েছেন স্বীকার করেছেন। এজন্য তিনি সৌদি পেশাদার লিগের লোভনীয় প্রস্তাবকেও প্রত্যাখান করেছেন।
পিএসজিতে আর্জেন্টাইন এই সুপারস্টারের সময়টা প্রত্যাশা মত কাটেনি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল তাকে পেয়ে নিজেদের আমুল বদলে ফেলার উপলক্ষ্য ঠিকই খুঁজে পেয়েছে।
২০২২ বিশ্বকাপ জয়ী আর্জেন্টাইন অধিনাকের হাতে যে এবারের ব্যালন ডি’অর ট্রফি উঠছে তা অনেকটাই অনুমেয় ছিল, হয়েছেও তাই। ক্যারিয়ারে অষ্টম ব্যালন ডি’অর জয় করে মেসি রেকর্ড বইয়ে আরো একবার নাম লিখিয়েছেন। ২০০৯ সালে প্রথমবার এই ট্রফি জয় করার পর থেকে বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে আর মেসিকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
৪. রোনাল্ডো সৌদি আরবে যাত্রা
ইউরোপীয়ান ক্যারিয়ার শেষ করে নতুন কোন রোমাঞ্চের খোঁজে সৌদি পেশাদার লিগের ক্লাব আল নাসরেতে নাম লেখান ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো। স্পোর্টিং লিসবন, ম্যানচেসটার ইউনাইটেড, রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাসের সাবেক এই পর্তুগীজ সুপারস্টারের জন্য সিদ্ধান্ত নেয়াটা মোটেই সহজ ছিলনা। কিন্তু ইউনাইটেড ছেড়ে দেবার পর খুব বেশীদিন ক্লাববিহীন থাকতে হয়নি রোনাল্ডোকে। যদিও ইউরোপের বেশ কিছু শীর্ষ ক্লাব তার প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রেনাাল্ডো নতুন বছরের শুরুতেই ট্রান্সফার মার্কেটে হইচই ফেলে দেন। রোনাল্ডোর পথ ধরে পরবর্তীতে আরো কিছু তারকা সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছেন যাদের মধ্যে অন্যতম হলেন নেইমার, করিম বেনজেমা, এন’গোলো কান্তে, সাদিও মানে, রুবেন নেভেস, রিয়াদ মাহরেজ, রবার্তো ফিরমিনো, অমারিক লাপোর্তে, জর্ডান হেন্ডারসন।
৫. নাপোলির উত্থান-পতন
সিরি-এ শিরোপা জয়ের পর ম্যানেজার লুসিয়ানো স্পালেত্তি নাপোলি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। ৬৪ বছর বয়সী স্পালেত্তির এর পিছনে কারন হিসেবে জানান, তিনি বেশ পরিশ্রান্ত। তার স্থানে রুডি গার্সিয়া নাপোলির দায়িত্ব নিলেও তিনিও মাত্র ১৬ ম্যাচ দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছিলেন। শিরোপা ধরে রাখার তাগিদে গার্সিয়ার স্থানে নতুন কোচ হিসেবে নাপোলি ওয়াল্টার মাজ্জারিকে নিয়োগ দেয়। মাঠ ও মাঠের বাইরে যদিও মাজ্জারিকে নিয়ে আলোচনা চলছেই। বিশেষ করে দলের মূল তারকা ওশিমেন বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হতাশা প্রকাশ করে ক্লাবের ভিতরকার পরিস্থিতি প্রকাশের চেষ্টা করেছেন। যদিও নাপোলির পক্ষ থেকে বিতর্কিত এই বিষয়গুলো সবসময়ই প্রত্যাখান করা হয়েছে।
৬. ম্যানচেস্টার সিটির ক্লাব বিশ্বকাপ জয় :
এ বছর আগেই চারটি শিরোপা জয়ের কৃতিত্ব নিয়ে গত সপ্তাহে সুস্পষ্ট ফেবারিট হিসেবে সৌদি আরবে ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিল ম্যানচেস্টার সিটি। সেমিফাইনালে জাপানের উওয়ারা রেডসকে ২-০ গোলে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে সিটিজেনরা। ফাইনালে ব্রাজিলিয়ান জায়ান্ট ফ্লুমিনেন্সকে ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত করে ২০২৩ সালে পঞ্চম শিরোপা জয় করে পেপ গার্দিওলার দল। জয়ের পার্থক্য আরো একবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ইউরোপীয়ান ক্লাবগুলোর তুলনায় বিশ্বের অন্যান্য ক্লাবগুলোর সুস্পষ্ট পার্থক্য।
এই শিরোপা জয়ের মাধ্যমে সিটি শুধুমাত্র ম্যানচেস্টার, ইউনাইটডে ও ইউরোপে নীল রঙ ছড়িয়ে দেয়নি, তার আভা এখন বিশ্বজুড়ে বিরাজ করছে।
৭. ইউরোপীয়ান আধিপত্য হুমকির মুখে :
ইউরোপের শীর্ষ ক্লাবগুলো ২০২১ সালে বিতর্কিত ইউরোপীয়ান সুপার লিগের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে বিপাকে পড়েছিল। ১২টি ক্লাবের মধ্যে ৯টি ক্লাব শেষ পর্যন্ত নানা হুমকির মুখে সুপার লিগের তকমা থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল। ইউরোপীয়ান সর্বোচ্চ সংস্থা উয়েফার পাশাপাশি বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রন সংস্থা ফিফাও এতে হস্তক্ষেপ করে, ক্লাবগুলোকে নিষিদ্ধের হুমকি দেয়।
শেষ পর্যন্ত তা সফল না হওয়ায় সুপার কাপ ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। কিন্তু এ বছর ক্লাবগুলোর আধিপত্যকে খর্ব করে ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর পথ ধরে বেশ কিছু শীর্ষ খেলোয়াড়ের সৌদি পেশাদার লিগে নাম লেখানো নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন এর মাধ্যমে ইউরোপীয়ান ফুটবলের একচ্ছত্র আধিপত্য শেষ হতে যাচ্ছে।
এর সাথে যোগ হয়েছে ডিসেম্বরে ইউরোপীয়ান কোর্ট অব জাস্টিস রায় দিয়েছে ইউরোপীয়ান সুপার লিগে যোগ দেবার ব্যপারে ক্লাবগুলোকে হুমকি দিয়ে উয়েফা ও ফিফা তাদের প্রতি অন্যায় করেছে। এতে ক্লাবগুলোর আধিপত্য অনেকাংশেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
৮. প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন লড়াই :
২০২৩ সালের প্রথমভাগে ম্যানচেস্টার সিটি ট্রেবল জয় করেছিল ঠিকই। কিন্তু বছরের দ্বিতীয় ভাগে এসে প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা লড়াই কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়ে। সিটি শীর্ষ চার থকে ছিটকে পড়ে, এই সুযোগে টটেনহ্যাম হটস্পার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের বাছাইপর্বের স্থানে উঠে আসে। দারুন শুরুর মাধ্যমে স্পার্সরা শীর্ষ চারের অবস্থান উপভোগ করতে থাকে। যদিও সিটির শিরোপা জয়ের দৌঁড়ে এখন সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে এ্যাস্টন ভিলা। সাবেক আর্সেনাল বস উনাই এমেরির অধীনে ভিলা এই মুহূর্তে লিভারপুলের সাথে সমান ৪২ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।
মাঠ ও মাঠের বাইরে নানা সমস্যায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড নিজেদের পথ কঠিন করে ফেলেছে। নিউক্যাসল, টটেনহ্যাম ও ওয়েস্ট হ্যামের সাথে লড়াই করে তাদেরকে শীর্ষ চারের অবস্থান পুনরুদ্ধার করতে হবে। টেবিলের মাঝামাঝিতে থাকা চেলসি আরো একবার শিরোপার দৌঁড় থেকে ছিটকে গেছে। লিভারপুল ও আর্সেনাল প্রত্যাশামতই এগিয়ে যাচ্ছে। পাঁচ শিরোপা জেতা সিটির জন্য এখন ২০২৪ সালের শুরু থেকেই নিজেদের এগিয়ে নেবার পথ খুঁজে নিতে হবে।
প্রিমিয়ার লিগে শিরোপা জন্য এতটা উন্মুক্ত অবস্থান এর আগে কোন সময়ই দেখা যায়নি। সাধারণত শীর্ষ দুই দলের মধ্যেই শিরোপার লড়াই টিকে থাকতো।
৯. ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের শেয়ার বিক্রি :
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মালিকানা নিয়ে সারা বছর জুড়েই আলোচনা ছিল। গ্লেজার্স পরিবাস ২০২২ সালের নভেম্বরে তাদের মালিকানা ছেড়ে দেয়। ইংলিশ ব্যবসায়ী ও ইউনাইটেড ভক্ত জিম র্যাটক্লিফ বছরের শেষভাগে এসে ২৫ শতাংশ শেয়ার কিনে নেন। তার আগে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী কাতারি ব্যবসায়ী জসীম বিন হামাধ আল থানি তার নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। যে কারনে র্যাটক্লিফ ও তার প্রতিষ্ঠানের পথ পরিস্কার হয়ে যায়।
১০. আন্ডারডগদের জন্য ইউরোপা কৃতিত্ব :
দুটি ইউরোপা কাপ জয়ের মাধ্যমে সেভিয়া ও ওয়েস্ট হ্যাম অপেক্ষাকৃত ছোট দল হিসেবে কন্টিনেন্টাল পর্যায়ে নিজেদের কৃতিত্ব দেখাতে সক্ষম হয়।
গত মৌসুমে উভয় দলই নিজেদের ঘরোয়া লিগে টেবিলের নীচের ভাগে থেকে মৌসুম শেষ করেছিল। কিন্তু ইউরোপা লিগে নিজেদের সাফল্য ধরে রেখেছিল। ইউরোপা লিগের ফাইনালে সেভিয়া হোসে মরিনহোর রোমাকে পেনাল্টিতে পরাজিত করে শিরোপা জয় করে। নির্ধারিত সময়ের ম্যাচটি ১-১ গোলে ড্র ছিল। স্প্যানিশ ক্লাব এর মাধ্যমে সাত বার ইউরোপা কাপের শিরোপা জয়ের কৃতিত্ব দেখায়। ফাইনালে পথে তারা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও জুভেন্টাসকে পরাজিত করেছে।
এদিকে ফিওরেন্টিাকে ফাইনালে ২-১ গোলে পরাজিত করে ইউরোপা কনফারেন্স লিগে শিরোপা জয় করে ওয়েস্ট হ্যাম। সাত গোল করে ফিওরেন্টিনার স্ট্রাইকার আর্থার কাবরাল টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন। এর মাধ্যমে ৪৩ বছরের শিরোপা খরা কাটিয়ে হ্যামার্সরা বড় কোন আসরে চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জণ করলো।
বাসস/এএসজি/নীহা/১৪২৬/স্বব