শিরোনাম
সাভার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়- এক যুবককে পুলিশ আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি) থেকে হাইওয়েতে ফেলে দেয়া হচ্ছে, তার হাত ছড়িয়ে আছে এবং পা ভাঁজ করা। এরপর এপিসির এক পুলিশ অফিসার বাম দিকের দরজা খুলে দেন এবং আরেকজন অফিসার ওপরের ঢাকনা খুলে যুবকটিকে টেনে বের করে অমানবিক ও নৃশংস কায়দায় রান্তায় ফেলে দেন।
যুবক তখনও জীবিত ছিল এবং শ্বাস নিচ্ছিল। যখন তাকে এপিসি থেকে ফেলে দেওয়া হয়, তখন তার হাত ছড়িয়ে ছিল এবং একটি পা এপিসির চাকার নীচে আটকা পড়ে ছিলা। এমন নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণ মানবতাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে।
শাইখ আসাবুল ইয়ামিন গত ১৮ জুলাই সাভারে ছাত্র-জনতা আন্দোলনের সময় শহিদ হওয়া প্রথম ছাত্র।
ফেলে দেওয়ার পর এক পুলিশ অফিসার এপিসি থেকে নেমে গুরুতর আহত প্রায় অচেতন ইয়ামিনকে হাত ধরে টেনে-হিঁচড়ে হাইওয়ের মাঝখানে নিয়ে যায় এবং আরো দু’জন পুলিশ অফিসার বের হয়ে তাকে মূল সড়ক থেকে টেনে-হিঁচড়ে সড়ক বিভাজকের দিকে নিয়ে যায়। এরপর তাকে ডিভাইডারের ওপর দিয়ে সার্ভিস লেনে ফেলে চলে যায়।
নৃশংস এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের এমন আচরণ মানবতাকে নাড়া দিয়েছে, যা মানবাধিকারের প্রতি চরম অসম্মান।
ইয়ামিনের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ২৩ বছর বয়সী ইয়ামিন রাজধানীর মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এমআইএসটি)’র কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
জানা যায়, ইয়ামিন ১৮ জুলাই সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে (বৃহস্পতিবার) ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেন ।
সেদিন সকাল থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত সাভারের সার্বিক পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক ছিল।
কিন্তু সকাল ১১টার দিকে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পাকিজা মোড়ে জড়ো হয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে।
এ সময় সেখানে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্য মোতায়েন ছিল। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে স্লোগান দিতে থাকে।
পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুুড়তে শুরু করলে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষ চলাকালে বেশ কয়েকটি যানবাহন ভাংচুর করা হয়। পুলিশের নির্বিচারে কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেটের মুখে বিক্ষোভকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
এ সময় হেলমেট পরা এবং লোহার রড, বাঁশের লাঠি, পিস্তল ও শটগানে সজ্জিত আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের কয়েক শতাধিক নেতাকর্মী ওই এলাকায় পুলিশ ও বিজিবি সদস্যদের সঙ্গে যোগ দিয়ে বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালায়।
পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা সেখানে কঠোর অবস্থান নিলে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হামলার মুখে বিক্ষোভকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
বেলা সাড়ে ১২টার দিকে আন্দোলনকারীরা আবার সংগঠিত হয়ে সাভার মডেল মসজিদের সামনে রাস্তায় নেমে আবার বিক্ষোভ শুরু করে। এ সময় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করলে সেখানে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
একপর্যায়ে সাভার বাসস্ট্যান্ড, সিটি সেন্টার, রাজ্জাক প¬াজার পুরাতন ওভারব্রিজ ও সাভার বাসস্ট্যান্ড থেকে মহাসড়কের বিপরীত পাশের সার্ভিস লেন ও গলিতে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা।
এ সময় পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়তে থাকে। আন্দোলনকারীরা কিছুটা পিছু হটলেই আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা তাদের ওপর নতুন করে হামলা চালায়।
দুপুর ২টার দিকে পুলিশ-বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে পুলিশের নেভি-ব্লু রংয়ের একটি এপিসি রাস্তার প্রধান সড়কে পুলিশের সঙ্গে যোগ দেয় এবং বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট, ছররা গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ শুরু করে।
ইয়ামিন তার শিক্ষিকার ছেলে গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে তাকে উদ্ধার করতে রাস্তার ডিভাইডার পেরিয়ে পিছন দিক থেকে এপিসিতে উঠে যান।
ইয়ামিন এপিসিতে ওঠার পরপরই এর ওপরের কভারটি বন্ধ হয়ে যায় এবং বুকের বাম পাশে গুলিবিদ্ধ হয়ে এপিসির ওপর পড়ে যান। তাকে এপিসি থেকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সার্ভিস লেনে ফেলে দেওয়া হয়।
প্রায় এক ঘণ্টা পর বিক্ষোভকারীদের কয়েকজন ইয়ামিনকে উদ্ধার করে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ডাক্তাররা ইয়ামিনের বুক ও ঘাড়ের বাম পাশে অসংখ্য ছররা গুলির ক্ষত রয়েছে বলে জানান।
ইয়ামিনের পরিবারে বাবা-মা ছাড়া তার এক বড় বোন আছে। তিনি তার পরিবার নিয়ে সাভারের ব্যাংক টাউন আবাসিক এলাকায় থাকতেন। ইয়ামিনের বাবা মহিউদ্দিন ব্যাংকার ছিলেন।
বাসসের সঙ্গে আলাপকালে ইয়ামিনের বাবা জানান, ওই দিন (১৮ জুলাই) তিনি একটি মসজিদে নামাজ পড়ছিলেন। এ সময় ইয়ামিনের মা তাকে ফোন করে বলেন, ইয়ামিন তার ফোন রিসিভ করছে না।
বাবা মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমি ফোনে তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। ইয়ামিনের সাথে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।
কিছুক্ষণ পর আমি একজনের কাছ থেকে একটি ফোন কল পাই এবং আমাদের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে আমরা সেখানে গিয়ে ইয়ামিনের লাশ দেখতে পাই।
ইয়ামিনের বাবা বলেন তারা ইয়ামিনের ময়নাতদন্ত করতে দেয়নি এবং শহিদ হওয়ায় তাকে জানাজা ছাড়াই দাফন করা হয়।
মহিউদ্দিন জানান, কুষ্টিয়ায় গ্রামের কবরস্থানে এবং সাভারের তালবাগ কবরস্থানে ইয়ামিনকে দাফন করতে চেয়ে বাধার সম্মুখীন হন তারা। পরে ইয়ামিনকে ব্যাংক টাউন কবরস্থানে দাফন করা হয়।
মহিউদ্দিন বলেন, মেধাবী ছাত্র হওয়ায় ছেলেকে ঘিরে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। ইয়ামিনের বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে শিক্ষক হিসেবে এমআইএসটিতে যোগদানের স্বপ্ন ছিল।
তিনি বলেন, কিন্তু এখন সেই সমস্ত স্বপ্ন দুঃখে পরিণত হয়েছে। ইয়ামিনের বাবা ইয়ামিনের খুনিদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।