শিরোনাম
॥ রুপোকুর রহমান ॥
সাভার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিজয় মিছিলে যোগ দিতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন মুন্না। মাসব্যাপী ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের বিজয় লগ্ন ৫ আগস্ট বিকেলে পতাকা হাতে বিজয় মিছিলে যোগ দিতে যান সাভার সরকারী কলেজের ¯œাতক (পাস) দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রোভার স্কাউট তানজীর খান মুন্না (২১)। কিন্তু পুলিশের গুলিতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও সময়মত চিকিৎসা না পেয়ে অকালে ঝরে যায় এই তরুণ প্রাণ।
মুন্নার বড় ভাই রাজীব খান বলেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের খবরে আমি আর আমার ভাইসহ মহল্লার অন্যরা বিজয় মিছিলে যোগ দিতে বেলা ২টার পরপরই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। মুন্না জাতীয় পতাকা হাতে বাসা থেকে বের হয়ে বিজয় মিছিলে যোগ দেয়।
মিছিল নিয়ে সাভার থানা রোডে অবস্থান নেয় মুন্না ও তার বন্ধুরা। এক পর্যায়ে তারা বিজয় মিছিল নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। কিছুক্ষণ পরই থানা থেকে কিছু পুলিশ বের হয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে সামনের দিকে এগোতে থাকে। এসময় বিজয় মিছিলের সামনে থাকা মুন্নার এক পায়ে গুলি বিঁধে অপর পাশ দিয়ে বের হয়ে অন্য পায়ে বিদ্ধ হয়। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
রাজিব জানান, সেসময় এলোপাতাড়ি গোলাগুলির কারণে মুন্নাকে তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালে নেয়া সম্ভব হয়নি। অনেকটা সময় রাস্তায় পড়ে থাকার পর স্থানীয়রা তাকে সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে অবস্থার আরো অবনতি হলে মুন্নাকে সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এরপরই অপরিচিত নম্বর থেকে রাজিবকে ফোন করে মুন্নার আহত হওয়ার ঘটনা জানানো হয়। খবর পেয়ে রাজিব দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার চেষ্টা করলেও রাস্তা বন্ধ থাকায় ঘুরপথে হাসপাতালে পৌঁছতে অনেক সময় লেগে যায়। ততক্ষণে মুন্নার অবস্থার আরো অবনতি হয়।
রাজিব ভাগলপুর হয়ে হাসপাতালের পেছন গেট দিয়ে ঢুকতে যেয়ে দেখেন সেখানেই কয়েকজনের লাশ। হতবিহ্বল রাজিব প্রথম এসব লাশের মাঝ্যেই নিজের ভাইকে খুঁজতে থাকেন। সেখানে না পেয়ে স্থানীয়দের পরামর্শে সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যোগাযোগ করেন। সেখানে ভাইকে খুঁজে পান গুলিবিদ্ধ অবস্থায়। এসময় চিকিৎসকরা জানান, মুন্নার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। দ্রুত অন্তত তিন ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। চিকিৎসক স্বল্পতা আর রোগীর ভীড়ের কারণে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না পেয়ে ক্রমেই মৃত্যুর দিকে ধাবিত হতে থাকে মুন্না। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মুন্নার শরীর রক্তশূন্য হয়ে পরে। তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। পরে এক ব্যাগ রক্ত যোগাড় করা হলেও ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। রাত ৮টার দিকে জীবন প্রদীপ নিভে যায় মুন্নার।
রাজিব আর মুন্না দুই ভাই। বাবা নেই। মা আর দুই ভাইয়ের ছোট্ট সংসার। বাাড়ি সাভার পৌরসভার আনন্দপুর সিটিলেনে। বড় ভাই রাজিব খান পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে রাজিব বলেন, ‘বাবা না থাকায় আমি, আমার মা, আমার স্ত্রী আর ছোট ভাই মুন্নাকে নিয়েই আমাদের সংসার। মুন্না আমার থেকে ১০ বছরের ছোট। ছোটবেলা খেকে আমিই ওকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি। দুধ খাইয়েছি। শুতো আমার সাথে। আমার সাথেই দিনের বেশিরভাগ সময় কাটাতো ও। এখন আমাদের ঘরটা শূন্য হয়ে গেলো।’
তানজীর খান মুন্না ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় ভালো ছিল। তাই নিজের পড়াশোনা বন্ধ হলেও ছোট ভাইয়ের পড়ালেখার যাবতীয় দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন রাজিব। কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও স্কাউটিং আর সামাজিক কর্মকা-ের অগ্রভাগে থাকায় বন্ধুদের কাছেও মুন্না ছিল প্রিয় পাত্র। শুধু বন্ধুরাই নয়, মুন্নার প্রশংসায় পঞ্চমুখ শিক্ষকরাও।
মুন্নার মা আমেনা বেগম ছেলের শোকে বারবার মূর্চ্ছা যাচ্ছেন। তার শোকাতুর স্বগোতক্তি, ‘রাজিব কাজে ব্যাস্ত থাকায় সবসময় মুন্নাই বাসায় থাকতো। আমার কাছাকাছি থাকতো। আমার খেয়াল রাখতো সবসময়। আমি কী করছি, খেয়েছি কি না, সবকিছুই দেখভাল করতো ও। এখন আমাকে কে দেখে রাখবে?’
এই সন্তানের দূঃখ কী দিয়ে ভুলবেন মা! আদরের ধন ছোট ছেলেকে হারিয়ে শারীরিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি। বেড়েছে ব্লাড পেশার আর ডায়াবেটিসও। সন্তানের এই মর্মান্তিক অকাল মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না কিছুতেই।
মুন্নার মৃত্যুতে তার বন্ধুদের মাঝেও নেমে এসেছে শোকের ছায়া। মুন্নার সহপাঠী হাসিবুল হোসেন বাপ্পী বলেন, ‘খুব মিশুক ছিল মুন্না। সবার সাথেই ভালো বন্ধুত্ব ছিল। অনেক ভালো মনের মানুষ ছিল সে। কোন রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল না। কোন খারাপ কাজ কখনো করেনি সে। সুন্দর ছবি তুলতো। রোভার স্কাউটের সদস্য হওয়ায় সবসময়ই কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতো মুন্না। আমরা সবাই তাকে নিয়ে গর্ববোধ করতাম। তার কার্যক্রম ছিল সবসময়ই গঠনমূলক। সমাজের ভালো কিছুর অগ্রভাবে থাকতো মুন্না। আমরাও সবাই মিলে মুন্নাকে সমর্থন দিতাম। সেও আনন্দ পেতো।
একজন রোভার স্কাউট ও ভালো ছাত্র হওয়ায় কলেজের শিক্ষকরাও ভালোবাসতেন মুন্নাকে। সাভার সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ ইমরুল হাসান বলেন, ‘সে ছিল অত্যন্ত ভালো মনের মানুষ। কখনো কারো সাথে খারাপ আচরণ করেনি। ছাত্র হিসেবেও ভালো ছিল মুন্না। তার মতো ছাত্র নিয়ে আমরা সবসময়ই গর্ববোধ করি। সবার সাথেই মিলেমিশে থাকতো। বন্ধুদের মধ্যমনি হয়েই থাকতো সে।’
আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-সুহৃদ সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে মুন্না। কিন্তু ন্যায়ের পক্ষে, সত্যের পক্ষে কাজ করেন যারা তারা মরে না। মুন্নারা ও কখনো মরবে না। হারিয়ে যাবে না। মুন্নারা অযুত-নিযুত বছর ধরে বেচেঁ থাকবে মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে।