বাসস
  ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩:১৫

বৈষম্যের অবসান চান দুই সাহসী যোদ্ধা মিশু ও তন্ময়

চট্টগ্রাম, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ (বাসস):রাষ্ট্রের সকল স্তর থেকে বৈষম্য দূর হোক চান কোটা বিরোধী আন্দোলনের দুই সাহসী সৈনিক মিশু ও তন্ময়। মেধা ও যোগ্যাতার মূল্যায়নের পাশাপাশি শিক্ষাঙ্গনে লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতির অবসান চান তারা। প্রতিহিংসার রাজনীতি ও মারামারি-হানাহানিমুক্ত নতুন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন তাদের চোখে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত জান্নাতুল রাহি (মিশু) ও তন্ময় দাস বাসস’কে এভাবেই নিজেদের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
জান্নাতুল রাহি (মিশু) চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৮ জুলাই দুপুরে তার হাতে গুলি লাগে। এদিন চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে ষোলশহর থেকে মুরাদপুর এলাকায় অবস্থান নিলে পুলিশ ও ছাত্রলীগ চারিদিক থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও গুলি চালায়। এতে অনেক ছাত্র গুরুতর আহত হন। মিশু তাদের একজন। তার গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রামের রৌমারি উপজেলায়। বাবার নাম মো. আমিনুল হক (মৃত), মা মোছাম্মৎ জান্নাতুন নাহার। তিনি এই দম্পতির ছোট ছেলে। তারা ২ভাই। বড় ভাই নাহিদ কুড়িগ্রামে ছোটখটো ব্যবসা করেন। স্বল্প আয়ে কোনো রকমে তাদের সংসার চলে। মিশু চট্টগ্রামের একটি মেসে থেকে টিউশনি করে পড়াশুনার ব্যয় বহন করে।
গুলিবিদ্ধ মিশু বাসস’কে বলেন, গত ১৮ জুলাই দুপুরে চট্টগ্রামের মুরাদপুরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন তিনি। সরকারি চাকুরিতে কোটা প্রথা সংস্কারের দাবি ও স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে শত-সহ¯্র সহযোদ্ধার স্লোগানে মুখর মিছিল চলাকালে তিনি হঠাৎ বুঝতে পারেন তার হাত অবশ হয়ে আসছে। দেখেন হাতে অনেক রক্ত। তখনো তিনি বুঝতে পারেন নি হাতে গুলি লেগেছে। পুরো শরীর রক্তে লাল হয়ে যায়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছিল। এ সময় তার কয়েকজন বন্ধু দ্রুত তাকে নগরীর অক্সিজেন এলাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে ভর্তি করানো হলে চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন, তাঁর হাতে লাগা বুলেট একপাশ দিয়ে বিদ্ধ হয়ে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে গেছে। প্রায় এক সপ্তাহ চিকিৎসাধীন থাকার পর ২৫ জুলাই হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়া হয়   তাকে। এ সময়টুকু ছিল খুব বিভীষিকাময় এবং কষ্টের।
কথাগুলো বলার সময় দুই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল সাহসী এই তরুণের।
গুলির ক্ষত বয়ে বেরালেও মিশু ভূলে গেছেন গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরবর্তী সময়গুলোর কষ্টের কথা। বলেন, ‘আমার আর কোনো কষ্ট নেই। আমার এবং আমার মতো হাজারো তরুণের ত্যাগের মাধ্যমেই স্বৈরচারী সরকারকে হঠাতে পেরেছি। এখন একটিই চাওয়া, আমরা যে বৈষম্য এবং গণবিরোধী হটকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আন্দোলন করেছি রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্র থেকে যেন এই বৈষম্য দূর হয়। রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে যেন মেধাকে মূল্যায়ন করা হয়। আবার কখনো এর ব্যত্যয় ঘটলে এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফল আমরা ভোগ করতে পারবো না। আমরা সবখানে মেধা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন চাই।’
মেধাবীদের মূল্যায়ন ও তাদের যথাযোগ্য স্থান সুনিশ্চিত হবে আশাবাদ ব্যক্ত করে মিশু বলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি দূর করতে হবে। যুগোপযোগী সিলেবাসের মাধ্যমে একটি স্মার্ট শিক্ষা পদ্ধতি প্রণয়ন করা জরুরি। বিশ^বিদ্যালয়গুলো শুধু বিসিএস ক্যাডার তৈরির আঁতুড় ঘর না হয়ে সৃজনশীল উদ্যোক্তা ও মানবিক মানুষ গড়ার প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠুক। সরকারের কাছে আহবান জানাই, ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সকল হত্যাকা- এবং পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের বর্বর মারধর ও নির্বিচারে গুলিবর্ষণে হতাহতের প্রতিটি ঘটনার যেন সুষ্ঠু বিচার করা হয়।’
চট্টগ্রামে গুলিতে আহত আরেক অকুতোভয় সৈনিক তন্ময় নাথের স্বপ্ন প্রতিহিংসার রাজনীতি ও মারামারি-হানাহানিমুক্ত নতুন এক বাংলাদেশের। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে এই প্রত্যাশার কথাই জানাতে চান তিনি।  
বাসস’র সাথে আলাপচারিতায় তন্ময় বলেন, ‘নগরীর নিউমার্কেট এলাকায় গত ৫ আগস্ট সকাল ১১টার দিকে পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছি। আমার পায়ে গুলি লেগেছিল। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছি।’
কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম এই যোদ্ধা বলেন, ‘আমি আন্দোলনের প্রথম থেকে সামনের সারিতে ছিলাম। আমাদের আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কোটার যৌক্তিক সংস্কার। আমরা চেয়েছি অহিংস আন্দোলন। ফলে আমরা প্রথম থেকে কোনো মারামারি হানাহানিতে যাইনি। কিন্তু সরকার তার বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে আমাদের ওপর বারবার হামলা করেছে। হামলায় ৫-৬ জন সহযোদ্ধার মৃত্যু হলে আমরা আন্দোলনকে আরো বেগবান করি। এক পর্যায়ে সারাদেশে কারফিউ ঘোষণা করা হলে সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে আমরা সরকার পতনের একদফার আন্দোলনের দিকে এগিয়ে যাই।’
তন্ময় নাথ (২৪) চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী। বাড়ি মিরসরাই উপজেলায়। তিনি গোপাল চন্দ্র নাথ ও রীনা দেবী দম্পতির সন্তান।  
তন্ময়ের পিতা গোপাল চন্দ্র নাথ বলেন, ‘তন্ময় আমার একমাত্র সন্তান। শত বাধা বিপত্তিতেও  আমরা ওকে আটকাতে পারিনি। নিজের বিবেকের তাড়নায় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে। আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। তন্ময় পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছে। সেই চিকিৎসার খরচ আমার পক্ষে বহন করা কষ্ট হয়ে যেত। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তার চিকিৎসার সকল ব্যয় বহন করেছে। তন্ময়সহ যারা এই আন্দোলন সংগ্রামে আহত হয়েছে তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ধন্যবাদ জানাই।’