বাসস
  ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৫৩
আপডেট  : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩:১৩

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন: নিহতদের শহিদি মর্যাদা চান সদ্যের পিতা

॥ রুপোকুর রহমান ॥
সাভার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সকল নিহতদের শহিদি মর্যাদা দেয়ার দাবি জানিয়েছেন সাফওয়ান আক্তার সদ্য (১৫)’র পিতা ডা.আক্তারুজ্জামান লিটন।
বাসস’র সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘ছেলেকে তো আর ফিরে পাবো না। তাই আমি চাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত সকলেই যেন শহিদি মর্যাদা পায়। আহতরা সুচিকিৎসা নিয়ে যেন বাড়ি ফিরতে পারে। তবেই কিছুটা হলেও মানসিকভাবে শান্তি পাবো।’
সাফওয়ান আক্তার সদ্য সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। অত্যন্ত মেধাবী সদ্য পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিল। ছোটবেলা থেকেই সামাজিক কর্মকান্ডে ঝোঁক ছিল তার। পড়াশোনার পাশাপাশি গান-বাজনায় সম্পৃক্ত ছিল। নামাজও পড়তো পাঁচ ওয়াক্ত। বড় বোন আতিয়া জামান তিষমা বাক প্রতিবন্ধী। দুই ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে ছোট্ট সংসার পশু চিকিৎসক  আক্তারুজ্জামান লিটনের। গত ৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেট কেড়ে নেয় সাফওয়ান আক্তার সদ্যের জীবন। সেই সাথে থেমে যায় পরিবারটির সব স্বপ্নও।
ছেলে হারানোর শোকে হতবিহবল আক্তারুজ্জামান লিটন বলেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শরীক
হতে শুরু থেকেই উদগ্রীব ছিল সদ্য। কিন্তু আমাদের চাপে বাড়ির বাইরে যেতে পারেনি। তবে বাড়ীর ছাদে
উঠে ছাত্রদের আন্দোলন দেখতো আর বাইরে যাওয়ার জন্য হইহুল্লো করতো। ওর এমন ছটফট অবস্থা দেখে
আমারও খারাপ লাগতো। আমাকে জিজ্ঞাসা করতো বাবা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন কি। তখন আমি বলতাম
এটা হচ্ছে কোটা বিরোধী আন্দোলন। যার কারণে অনেক মেধাবীরা সুবিধা বঞ্ছিত। ঘটনার দিন ৫আগস্ট
যখন শুনলাম ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক দিয়ে রোর্ড মার্চ টু ঢাকা’র উদ্দেশ্যে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা ঢাকার দিকে ছুটছে তখন আমি আমার প্রতিবেশী ব্যাংকার আবু সাঈদসহ অন্যরা বাড়ীর বাইরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যাই। ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক তখন লোকে লোকারণ্য। তখন আমি সদ্যের মা’কে ফোন দিয়ে বলি সদ্যকে বাড়ীর সামনে সড়কে আসতে বলো। এখবর শুনে আনন্দে আত্মহারা সদ্য দৌড়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে চলে আসে। তখন আমরা সবাই মিলে হাত নেড়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাওয়া ছাত্র-জনতাকে স্বাগত জানাই।
তিনি বলেন, তার কিছুক্ষণ পর খবর পেলাম সেনাপ্রধান দুপুর ২টায় ভাষণ দিবেন। কিন্তু টিভিতে ভাষণ পেলাম না। শুনলাম বিকেল ৪টায় সেনা প্রধানের ভাষণ প্রচারিত হবে। তার কিছুক্ষণ পরই জানতে পারি শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে চলে গেছেন। তখন দেখি পুরো সড়কজুড়ে মানুষের সমাগম। সবাই যার যার বাসা থেকে সড়কে বেড়িয়ে এসেছে। বিজয় মিছিল নিয়ে সামনের দিকে যাচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো এলাকা। যোগ দেন আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাসহ সকলেই। আমি, সদ্যসহ আমার এলাকার অনেকেই তখন মিছিলে যোগ দেই। মিছিলটি পাকিজা এলাকায় গিয়ে অবস্থান নেয়। বিকেল ৪টা বেজে যাওয়ায় সদ্যের মা দুপুরের খাওয়ার জন্য আমাদের বাড়ী ফেরার তাগিদ দিলে আমি সদ্যকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হই। এসময় সদ্যের কয়েকজন বন্ধুর সাথে সদ্যের দেখা হয়ে যাওয়ায় সদ্য আর বাসায় যেতে রাজী হয়নি। বলছিল আমি পরে বাসায় গিয়ে খাবো। তুমি চলে যাও। আমিও ভাবি এখন তো আর সহিংসতা হওয়ার কোন কারণ নেই, তাই আমি ওখানে ছেলেকে রেখেই পৌনে ৫টার দিকে বাসায় চলে আসি।
রাত ৮টায়ও যখন সদ্য বাসায় ফেরে না, তখনই তার বাবা-মা চিন্তিত হয়ে পড়েন। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ-খবর নিতে শুরু করেন। কোন খোঁজ না পেয়ে সদ্যের গৃহ শিক্ষক অমিত সাহাকে নিয়ে ছেলের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন আক্তারুজ্জামান। গেন্ডা বাসস্ট্যান্ড, থানা বাসষ্ট্যান্ডসহ থানা রোডে খোঁজ নিয়ে না পেয়ে সরকারি হাসপাতাল, এনাম মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নেন। রাত ৯টার দিকে এনাম মেডিকেল কলেজ
হাসপাতালের কয়েকজন লোক তাদের জানান হাসপাতালের পাশেই গাড়ি পার্কিংয়ে কিছু লাশ পড়ে আছে।  একথা শুনে সদ্যের গৃহশিক্ষক অমিত সাহা দ্রুত সেখানে ছুটে গিয়ে সদ্যের মৃতদেহ শনাক্ত করে। খবর পেয়ে ছুটে যান সদ্যর বাবাও। সেখানে একমাত্র ছেলে সদ্যের নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখেন। পরে এনাম মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতাল থেকে মৃত্যু সনদ নিয়ে পরদিন গ্রামের বাড়ি জামালপুরে পারিবারিক কবরস্থানে সদ্যকে দাফন করা হয়।
সদ্যের প্রতিবেশী আবু সাঈদ বলেন, আমরা বেশ কিছুদিন ধরেই সদ্যদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকি। কোনদিন ওকে কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করতে দেখি নাই। তিনি বলেন, মহল্লার সবাই ওর ভালো ব্যবহারের জন্য ওকে আদর করতো। বাবা-মা’র বাধ্য ছেলে ছিল সদ্য। সদ্যকে হারিয়ে ওর পরিবারের মতো আমরা এলাকাবাসীও শোকে কাতর।
সাফওয়ান আক্তার সদ্যের মা খাদিজা বিন জুবাইদ বার বার মুর্চ্ছা যাচ্ছিলেন। ছেলে হারানোর বেদনায় যেন নিজেই তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছেন তিনি। ছেলে সদ্যের বিষয়ে বলেন, সদ্য ছিল অন্য অনেকের থেকে আলাদা। ওর মতো ছেলে যার ঘরে জন্মাবে তারা অবশ্যই ভাগ্যবান। আমার ছেলে কখনোই কোন অন্যায় করেনি। যখন যা বলেছি, তাই শুনেছে। ওর বড় বোনটি বাক প্রতিবন্ধী। ওর বাবার কর্মস্থল বাইরে থাকায় সংসারের ছোট ছোট কাজগুলো সদ্যই করতো। নামাজ- রোজা করতো।
সদ্যরা হারাবে না, সদ্যরা হাজার বছর বেচেঁ থাকবে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে। ইতিহাসের পাতায়।