শিরোনাম
ঠাকুরগাঁও, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ (বাসস): বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় হৃদয় কুমার সাগরের শরীরে ৩৭টি গুলি বিদ্ধ হয়। এই কিশোর তার বন্ধুদের সাথে জুলাই-আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানে যোগ দিয়েছিল, যা স্বৈরাচারী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশের রাজনৈতিক গতিপথ পাল্টে দেয়।
সাগরের বাবা রবিন চন্দ্র দাস (লালন) ঠাকুরগাঁওয়ে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) অধীনে কর্মরত চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। তিনি তাদের চার সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী।
সাগর ও তার বোনের লেখাপড়াসহ সংসারের খরচ বহন করতে তার বাবার খুব কষ্ট হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রায় পরিত্যক্ত কলোনীতে দারিদ্র্যপীড়িত এই পরিবারটির বসবাস।
প্রত্যক্ষদর্শী ও সাগরের বন্ধু মেহেদী হাসান মীম জানায়, গত ১৮ জুলাই সে ও তার বন্ধু মনির হোসেন এবং হৃদয় কুমার সাগর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমপ্লিট শাটডাউন চলাকালে আন্দোলনে যোগ দেয়।
তিনি বলেন, ‘একপর্যায়ে পুলিশ আমাদের ওপর অপ্রত্যাশিতভাবে অতর্কিত হামলা চালায়। এতে আমার বন্ধু সাগরসহ অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়’।
মেহেদী হাসান বলেন, কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ার মধ্যে হৃদয় আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে যায়। আমরা তাকে কোনোভাবে রিকশায় করে ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যার সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাই। চিকিৎসকরা আমাদের জানিয়েছিলেন যে, সাগরের গায়ে ৩৭টি গুলি লেগেছে’।
তার বন্ধু মনির হোসেন ও একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘আমরা সাগরকে এমন গুরুতর আঘাত নিয়ে আন্দোলনে আসতে নিষেধ করেছিলাম, কিন্তু সে ১ দিনের বিরতি নিয়ে আবার আন্দোলনে অংশ নেয়’।
আন্দোলনের শেষ দিন পর্যন্ত সাগর মিছিল-সমাবেশে যোগ দিয়েছে এবং মাঝে মাঝে হাসপাতালে চিকিৎসাও নিয়েছে।
বাসস এর সাথে আলাপকালে সাগর আবেগাপ্লুত কন্ঠে বলেন,‘আমারতো প্রায় কিছুই হয়নি, সারাদেশে আমার কত বন্ধু প্রাণ হারিয়েছে, কতজনকে পুলিশ ও ছাত্রলীগ ধরে নিয়ে গেছে, যারা আর বাড়ি ফেরেনি। আমি আহত হয়েও বাবা-মা ও বোনের কাছে ফিরে আসতে পেরেছি। আমার অনেক বন্ধু আর কখনো ফিরে আসবে না’।
প্রত্যেক দরিদ্র পিতা-মাতার মত সাগরের বাবা-মায়েরও প্রত্যাশা তাদের ছেলে একদিন বড় হয়ে পরিবারের কষ্ট দূর করবে। তবে জেলা শহরের নিশ্চিন্তপুরের হ্যাডস ইনস্টিটিউট অফ এগ্রি টেকনোলজির চতুর্থ সেমিস্টারের ছাত্র সাগরের সুস্থ হওয়ার বিষয়ে পুরো পরিবার এখন চিন্তিত।
সাগরের বাবা রবিন চন্দ্র দাস বলেন, তিনি একজন সাধারণ কর্মচারী হিসেবে ছেলে মেয়ের লেখাপড়াসহ সংসারের খরচ চালাতেই হিমশিম খাচ্ছেন।
তিনি বলেন, ‘আমার কষ্টের সময়ে ছেলেটাও এভাবে আহত হলো। তার চিকিৎসার খরচ মেটাতে অনেক ঋণ করেছি। চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন কিন্তু বেশির ভাগ ওষুধই বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আমার ছেলের চিকিৎসার ব্যয় মেটানো আমার জন্য খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে।’
তিনি আরো বলেন, অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সাগরের পা, বুক ও পেট থেকে ৫-৬টি বুলেটের অংশ বের করা হলেও বাকিগুলি ছোট থেকে বড় ক্ষত তৈরি করেছে।
ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. রকিবুল আলম চয়ন জানান, সাগরের চিকিৎসায় দীর্ঘ সময় লাগবে।
রক্তক্ষরণের কারণে সাগরকে পর্যাপ্ত সুষম খাবার দেওয়ার জন্য তিনি পরিবারকে পরামর্শ দিয়েছেন।
চিকিৎসক জানান, সাগরের চিকিৎসার বয়ের হিসাব পেলে এই ব্যয়ভার বহনের জন্য তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করবেন।
হ্যাডস ইনস্টিটিউট অব এগ্রি টেকনোলজির অধ্যক্ষ সফিউল আলম টেলিফোনে বাসসকে বলেন, সাগরের আঘাতের খবর তিনি জানেন না। সাগর এবং তার পরিবার তাকে বিষয়টি জানায়নি বলেও জানান তিনি।
ঘটনার ১৫ দিন পর হলেও বিষয়টি তার অজানা থাকাটা তার ব্যর্থতা কি না সে প্রশ্নের উত্তরে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেন।
পরে অধ্যক্ষ সাগরকে ফোন করে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করলেও বিষয়টি নিয়ে তার কোনো উদ্যোগের কথা জানাননি।
সাগরের বন্ধুরা জানান, সাগর শুধু ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেননি, রক্তদানসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজেও তার নিয়মিত সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল।
ঠাকুরগাঁওবাসীর প্রত্যাশা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সাগরসহ গণঅভ্যুত্থানের আহতদের পাশে দাঁড়াবে।