বাসস
  ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৫:০৮

ঘর মাতিয়ে রাখা শান্ত’র মতোই স্তব্ধ তার পড়ার টেবিল, লেখার খাতা

॥ কলিম সরোয়ার ॥
চট্টগ্রাম, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত শান্ত’র বাবা-মা আজ পুত্র শোকে স্তব্ধ। তাদের মতোই স্তব্ধ হয়ে গেছে শান্তর পড়ার টেবিল, লেখার খাতা-বই, আসবাবপত্র, পোশাক। সারাক্ষণ ঘর মাতিয়ে রাখা শান্ত আজ চিরদিনের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেছে, এটা মানতে পারছে না তার পরিবার। প্রায় দু’মাস হয়ে গেলো, একদিনের জন্যও প্রাণ ফেরেনি শান্ত’র পরিবারে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ছোট্ট বাড়িটিতে কবরের নিস্তব্ধতা। থেমে থেমে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন শান্ত’র মা কোহিনুর বেগম। ভাইয়ের ছবি আর ব্যবহার্য জিনিসপত্র বুকে চেপে ধরে কান্না করছে শান্ত’র ছোট বোন।
কোহিনুর বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলে সারাদিন বাসা মাতিয়ে রাখতো, কিন্তু এখন নিষ্প্রাণ আমাদের পরিবার। আমার মেয়েটিও সারাক্ষণ ভাইয়ের ছবি আর ব্যবহার্য জিনিসপত্র বুকে চেপে ধরে কান্না করছে ।’
শান্ত’র বাবা জাকির হোসেন বাসস’কে বলেছেন, ‘আমার ছেলে শহিদ হয়েছে। আমি আমার শান্তশিষ্ট একমাত্র পুত্র সন্তানকে হারিয়ে ফেললাম। তাকে নিয়ে আমার অনেক আশা ছিল। বড় হয়ে সে একজন মানুষের মত মানুষ হবে। আমাদের পরিবারের ঘড়ির কাঁটা থেমে গেছে সেই ১৬ জুলাই। আনন্দে ভরে থাকা ঘরটিতে এখন কবরের নীরবতা। তার পড়ার টেবিল, ব্যবহার্য জিনিস আর পোশাক ঠিক আগের মতোই থরে থরে সাজানো।’
নগরীর ষোলশহর নিবাসী  ব্যবসায়ী জাকির হোসেন এবং কোহিনুর বেগম দম্পতির দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার। বড় ছেলে ফয়সাল আহমেদ শান্ত চট্টগ্রামের ওমরগনি এমইএস কলেজের বিবিএ প্রথম বর্ষের ছাত্র। ছোট মেয়ে একটি মাধ্যমিক স্কুলে নবম শ্রেণির ছাত্রী। জাকির হোসেনের গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলার বাবুগজ্ঞ উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নে। জীবিকার তাগিদেই চট্টগ্রামে আবাস গড়েন তিনি।
গত ১৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী  ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে গিয়ে চট্টগ্রামের ষোলশহরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ফয়সাল আহমেদ শান্ত (২০)। তারপর থেকেই তার পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। শান্ত’র শূণ্যতা যেন গ্রাস করেছে পুরো বাড়িটিকে।
জাকির হোসেন বলেন,ঘটনার দিন দুপুর ১২টার দিকে শান্তর সাথে সর্বশেষ কথা হয়। তখন শান্ত জানিয়েছিল, সে প্রাইভেট পড়তে বের হয়েছে। কিন্তু প্রাইভেট পড়ে আর ঘরে ফেরা হয়নি শান্ত’র।
তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে কখনো কোনো ঝামেলা বা ঝগড়া-বিবাদে জড়িত হতো না। স্কুল-কলেজ ও এলাকায় কখনো কারো সাথে তার বিরোধ ছিলো না। শান্ত’র নামে কখনো কোনো অভিযোগ আসেনি বাসায়। এমন ছেলেকে পুলিশ গুলি করে মারবে আমরা কখনো ভাবতেও পারিনি।’
তিনি জানান, প্রাইভেট পড়ে বন্ধুদের সাথে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে গিয়েছিল শান্ত। সেখানে মিছিলে পুলিশ ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালালে শান্তর বুকে তিনটি গুলি লাগে। এরপর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরদিন ১৭ জুলাই দুপুর ২টায় শান্তকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
সন্তান হত্যার সুষ্ঠু বিচার দাবি করে জাকির হোসেন বলেন, ‘আমার ছেলে একটি সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দিয়েছে। আমি শহিদের বাবা। কোটা আন্দোলন করতে গিয়ে সারাদেশে যারা শহিদ ও আহত হয়েছেন বর্তমান সরকার যেন তাদের পরিবারকে যথাযথ সহায়তা প্রদান করে এই দাবি জানাচ্ছি।’
তিনি একটি সুষ্ঠু বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
আন্দোলনের সময় আইন-শৃংখলা বাহিনীর ভূমিকার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘আমার নিষ্পাপ ছেলেকে জীবিত অবস্থায় কেউ নিরাপত্তা দেয়নি। কিন্তু যেদিন লাশ নিয়ে এসেছে সেদিন তার সামনে পিছনে ছিল পুলিশের গাড়ি। এমন রাষ্ট্র ব্যবস্থা আমরা চাই না যেখানে মানুষের জীবনের নিরপত্তা নেই।’