বাসস
  ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৮:৪৫

জুম্মার নামাজ পড়ে এসে পরিবারের সাথে খাওয়া হলো না : বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে শহিদ হলেন মোসলেহ উদ্দিন

॥ দিদারুল আলম ॥
ঢাকা, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : জুম্মার নামাজ পড়ে এসে দুপুরের খাবার খাবেন পরিবারের সাথে এমনই কথা ছিল মো. মোসলেহ উদ্দিনের। তবে জুম্মার নামাজের পর পরিবারের কাছে ফিরেছে তার গুলিবিদ্ধ নিথর দেহ।
দিনটি ছিল ১৯ জুলাই শুক্রবার। স্ত্রী সন্তান অপেক্ষায় ছিলেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী মানুষটিকে হারিয়ে এক শিশু পুত্রকে নিয়ে এখন দিশেহারা তার অসুস্থ সন্তান সম্ভবা স্ত্রী। অনাগত সন্তানের মূখ দেখে যেতে পারলেন না মোসলেহ উদ্দিন।
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে রাজধানীর রামপুরা বাংলাদেশ টেলিভিশনের পিছনে আতিক মসজিদের পাশে রামপুরা ডেমরা সড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে ১৯ জুলাই শুক্রবার নির্মমভাবে নিহত হন লন্ড্রিম্যান মো. মোসলেহ উদ্দিন।
আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে নিহত হওয়ার পর মোসলেহ উদ্দিনের পরিবারের খোঁজ রাষ্ট্র বা সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কেউ নিতে আসেননি। তবে মোসলেহ উদ্দিনের শহিদ হওয়ার বিষয়ে প্রতিবেদনের প্রয়োজনে বাসসসহ দুজন গণমাধ্যমকর্মী এসেছেন।
রাজধানীর রামপুরা বিটিভির পিছনে বনশ্রী আবাসিক এলাকার ব্লক-এ এর আতিক মসজিদের গলিতে একটি লন্ড্রি (মদিনা লন্ড্রি) পরিচালনা করতেন মোসলেহ উদ্দিন। তিনি ১৯ জুলাই শুক্রবার দোকান বন্ধ করে জুমার নামাজ আদায় করেন আতিক মসজিদে। ওই সময় রামপুরা-ডেমরা সড়কে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিক্ষোভ করছিল। এ সময় বিটিভির পাশ থেকে আন্দোলনকারীদের দিকে নির্বিচার গুলি ও টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সড়কে অবস্থান নেয়া আন্দোলনকারী ও জুমার নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হওয়া মুসল্লিরা যার যার বাসায় যেতে সড়কে একাকার হয়ে যায়। ওই সময় বিটিভির পাশে অবস্থান নেয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি এসে মোসলেহ উদ্দিনের বুকে ও গলায় বিদ্ধ হয়। আশপাশের লোকজন তাকে বনশ্রী ফরাজী হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মোসলেহ উদ্দিন ভোলা জেলার লালমোহন উপজেলার গজারিয়া গ্রামের মৃত হানিফ মিয়ার পুত্র। তার স্ত্রী নাসরিন আক্তার সন্তান সম্ভবা। আরেক সন্তান ১০ বছর বয়সী পুত্র আফরান প্রতিবন্ধী। লন্ড্রি দোকান পরিচালনা করে তিনি সংসার চালাতেন। 
স্ত্রী নাসরিন আক্তার জানান, আন্দোলনের কারণে থানা অকার্যকর থাকায় পোস্টমর্টেম ছাড়াই পূর্ব রামপুরা মোল্লাবাড়ী নিরিবিলি কবরস্থানে তার স্বামী মোসলেহ উদ্দিনকে দাফন করা হয়। মোসলেহ উদ্দিন পূর্ব রামপুরার জাকের গলির ২৫০ নম্বর বাসায় পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকতেন। জুলাই মাসের ১৯ তারিখসহ পরবর্তী সময় গুলোয় দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ থাকায় ভোলার লালমোহনে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে তাকে দাফন করা সম্ভব হয়নি।
নাসরিন আক্তার জানান, লন্ড্রিদোকান ব্যবসা চালু করা এবং অসুস্থ ছেলের চিকিৎসা ও সংসারের খরচ চালাতে মোসলেহ উদ্দিন তিন লক্ষ টাকা ঋণ করে গিয়েছেন। তিনি সন্তান সম্ভবা। তার আগামী দিনগুলো কিভাবে কাটবে এই ভেবে তিনি কোন কুল কিনারা পাচ্ছেন না।
ফরাজী হাসপাতালের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তাও গুলিবিদ্ধ হয়ে মোসলেহ উদ্দিনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ১৯ জুলাই ফরাজী হাসপাতালে দুইশোর মতো লোক গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চিকিৎসার জন্য গিয়েছে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়।
আতিক মসজিদে ১১ জুলাই জুমার নামাজ পড়তে যাওয়া সুপ্রিম কোর্টের এডভোকেট ডেপুটি এটর্নি জেনারেল মুজিবুর রহমানসহ ওই গলির অন্যান্য ব্যবসায়ীগণ, গুলিবিদ্ধ হয়ে মোসলেহ উদ্দিনের মৃত্যুর ঘটনা বর্ণনা করেন।
স্থানীয়রা জানান, মোসলেহ উদ্দিন খুবই ধার্মিক ভদ্র ও নিরীহ প্রকৃতির ছিলেন। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মোসলেহ উদ্দিনের নির্মমভাবে নিহত হওয়ার ঘটনা বনশ্রী ও পূর্ব রামপুরা এলাকায় মানুষের মুখে মুখে।
উল্লেখ্য সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি জানিয়ে আন্দোলন করে আসছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে যৌক্তিকভাবে সমাধানের পথে না গিয়ে বিগত আওয়ামী সরকারের সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদেরকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমনে লেলিয়ে দেয়া হয়। পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বিগত সরকারের নির্দেশে কঠোর অবস্থানে থেকে শিক্ষার্থীদের উপরে চড়াও হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হন। ওইদিন দেশব্যাপী ছয় জনের মৃত্যু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ সারা বাংলাদেশের ছাত্র জনতা ফুসে ওঠে। পর্যায়ক্রমে এ আন্দোলন এক দফায় রূপ নেয়। আন্দোলনকে দমন ও নির্মূল করতে গিয়ে তৎকালীন আওয়ামী সমর্থিত ক্যাডার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সহস্রাধিক মানুষ নির্মমভাবে গুলিতে নিহত হন। কয়েক হাজার মানুষ গুলিতে মারাত্মক আহত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। 
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, গণতন্ত্রকামী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ ও সাধারণ মানুষের লাল বিপ্লবে বাংলা বসন্তের ফলে গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এরপর বিগত সংসদ ভেঙে দেয়া হয়। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ  ইউনূসের নেতৃত্বে শপথ নেয় নতুন অন্তর্বর্তী সরকার। বিদায়ী সরকারের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, অপশাসন হত্যা গণহত্যা গুমের সাথে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন নতুন সরকার।