শিরোনাম
মাগুরা, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ (বাসস): স্বামী সন্তান নিয়ে দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করতে করতে বেঁচে থাকাও হয়তো স্বস্তির ছিলো সুমি বেগমের কাছে। কিন্তু স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুতে দুই কন্যা সন্তান নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছেন শহিদ হকার আল আমিনের স্ত্রী। একদিকে স্বামী হারানোর বেদনা, অন্যদিকে সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যত ভেবে চোখে অন্ধকার দেখছেন তিনি।
এদিকে বৃদ্ধা মায়ের আহাজারি, “বাবা আমার কোথায় চলে গেল। আর কোন দিন ফিরে আসবে না। আমাকে বলবে না ঠিকমত ওষুধ খাও।”
মাগুরা জেলা শহরের বরুণাতৈল গ্রামের আলেফ বিশ্বাস ও সূর্য বেগমের পুত্র আল আমীন। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে আল আমীন বড়। পেশায় ছিলেন হকার। স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে ঢাকার সাভারে বাসা ভাড়া করে থাকতেন তিনি। সাভার বাস স্ট্যান্ডে যাত্রীবাহী বিভিন্ন বাসে যাত্রীদের কাছে পানি, জুস ও ক্ষীরাসহ নানা ধরনের খাদ্য সামগ্রী বিক্রি করা ছিল তার পেশা।
গত ৫ আগস্ট দুপুরে আন্দোলনকারী বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার সাথে ঢাকার সাভার থানা ঘেরাও করলে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন আল আমীন।
আল আমীনের স্ত্রী সুমি বেগম বাসসকে জানান, ৫ আগস্ট দুপরে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকারীরা সাভার থানা ঘেরাও করে। এ আন্দোলনে যোগ দেয় তার স্বামী। পরে বিকেল সাড়ে ৪ টার দিকে খবর আসে গুলিবিদ্ধ আল আমীনকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। তখন সুমি বেগম হাসপতালে ছুটে যান।
তিনি বলেন, সেদিন হাসপাতালে অনেক মানুষ আহত অবস্থায় ছিল। চিকিৎসক ও নার্সরা রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমসিম খাচ্ছিল। রাত ৯ টার দিকে আমার স্বামী আল আমিনের মৃত্যু হয়। তার হত্যার বিচার চেয়ে ঢাকা জজকোট আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করেছি।
সুমি বেগম আরো বলেন, আল আমীনের একার আয় দিয়েই দুটো সংসার চলতো। সংসার খরচের পাশাপাশি গ্রামের বাড়িতে তার বাবা মায়ের কাছে টাকা পাঠাতো আমার স্বামী। তার সামান্য আয়ে কোনোমতে সংসার চলতো। আমরা গরিব মানুষ। স্বামী মারা যাওয়ায় আমার সব শেষ হয়ে গেছে। সন্তানদের জন্যও কিছু রেখে যেতে পারেনি। আমার দুটো মেয়ে নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তার মধ্যে আছি। এদের কিভাবে মানুষ করবো। কি ভাবে চলবো। আমি দুচোখে অন্ধকার দেখছি!
এদিকে ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন শহিদ আল আমীনের মা সূর্য বেগম। আল আমীনের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তার মা সূর্য বেগমের সাথে। তিনি জানান, কিছু দিন আগে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ায় এখন ঠিকমত চলা ফেরা করতে পারেন না। স্বামীর বয়স হয়েছে। ছেলের দেয়া টাকায় নিজের ওষুধ ও সংসার খরচ চালাতেন। ছেলের আকস্মিক মৃত্যুতে এখন সংসার চালানোই দায়।
আল আমীনের ছোট ভাই মো. রুহুল আমিন বলেন, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট ছাত্র জনতা সাভার থানা ঘেরাও করে। ওই সময় আমার ভাই আন্দোলনে ছিল। বেলা আড়াইটার দিকে পুলিশ গুলি চালালে আমার ভাইয়ের বাম পায়ে গুলি লাগে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় প্রায় আধা ঘন্টা সাভার থানার সমানে পড়ে ছিল। পরে এলাকাবাসী তাকে উদ্ধার করে সাভার এনাম মেডিকেলে নিয়ে যায়। সেখানে আহত অবস্থায় বারান্দায় পড়ে ছিল আমার ভাই। হাসপাতালের চিকৎসকরা ক্ষত স্থান পরিস্কার করে পায়ে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দেয়। কিন্তু রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণেই আমার ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে।
শহিদ আল আমীনের প্রতিবেশী মোহাম্মদ আনসার জানান, আল আমীনের মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি লাশ গ্রামের বাড়িতে নেয়ার জন্য সাভারে মহব্বত নামের এক ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করেন। ঐ ব্যক্তিকে বিকাশে টাকা পাঠালে তিনি আল আমীনের লাশ তার গ্রামের বাড়িতে পৌঁছাতে সহযোগিতা করেন। তার সহযোগিতায় পরদিন ৬ আগস্ট ভোর সাড়ে ৫টায় আল আমীনের লাশ এ্যাম্বুলেন্সে করে মাগুরার বরুনাতৈল গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায়। ঐদিন সকাল ১১ টায় ব্যাপারিপাড়া মসজিদের সামনে জানাজা শেষে স্থানীয় গোরস্থানে আল আমীনকে দাফন করা হয়।
আল আমীনের পরিবারের এই দুর্দিনে সরকার ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সহযোগিতা কামনা করেছেন পরিবারের সদস্য এবং এলাকাবাসী। তাতে শহিদ আল আমীনের আত্মাও শান্তি পাবে বলে মনে করছেন সকলে।