শিরোনাম
বরগুনা, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ (বাসস): বাবাকে সারাক্ষণ খুঁজে ফিরছে ছোট্ট তামান্না’র চোখ দুটি। সে শুনলেও বোঝেনা, বোঝার মতো বয়সও হয়নি যে তার। স্নেহময় প্রিয় বাবা চিরতরে চলে গেছে অজানা এক দেশে, অচেনা গন্তব্যে। আর কখনই ফিরবে না বাবা। তামান্নার সাত বছর বয়সী ভাই সাইমুনের কান্না দেখে প্রতিবেশিরাও চোখের পানি ধরে রাখতে পারছে না। ঢাকার ধানমন্ডিতে কাজে যাওয়ার সময় গুলিতে নিহত প্রাইভেটকার চালক মো. টিটু হাওলাদারের (৩৫) বাবা আব্দুর রহিম হাওলাদার সন্তান হারিয়ে পাগলপ্রায়। স্ত্রী আয়েশা বেগম তিন শিশু সন্তান নিয়ে দিশেহারা। চরম আর্থিক অভাব অনটনের মধ্যে সংসারের দিন কাটছে।
বরগুনার বেতাগী উপজেলার হোসনাবাদ ইউনিয়নের প্রত্যন্ত দক্ষিণ হোসনাবাদ গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রহিম হাওলাদারের ছেলে টিটু হাওলাদার। তার মা রাশেদা বেগম সাপের কামড়ে মারা যান আরও চার বছর আগে। টিটু ঢাকার ধানমন্ডির গ্রীন-লাইফ হাসপাতালের চিকিৎসক সাখাওয়াৎ আলমের প্রাইভেটকার চালাতেন। টিটু ও আয়েশা দম্পতির বড় মেয়ে তানজিলার বয়স ১০ বছর, ছেলে সাইমুন ৭ বছরের ও ছোট্র মেয়ে তামান্নার বয়স সবে ৬ মাস।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, বেশিরভাগ সময়ে সন্তানের কবরের পাশে বসে বৃদ্ধ বাবা আব্দুর রহিম হাওলাদার বিলাপ করে বলেন, এবারে আমার ছেলে ঢাকায় যাওয়ার সময় বলেছিলো, বাবা ওদের দেখে রেখো। এই ছিলো আমার ভাগ্যে? আমার বুকের মানিক ছেলেকে পাখির ন্যায় গুলি করা হয়েছে। আমার আর এখন বেঁচে থেকে কী লাভ। তার অনেক স্বপ্ন ছিলো,তা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে।
টিটু’র স্ত্রী আয়েশা বেগম জানান, এবারে টিটু সর্বশেষ গত ১১ জুলাই বাড়ি থেকে কর্মস্থল ঢাকায় যান। বাড়িতে থাকা অবস্থায়ই ঘরে বাজার ছিলো না। এর পর গত ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকেলে ফোন করে তাদের এক নিকট আত্মীয় জানান, তোমার স্বামীর শরীরে গুলি লেগেছে। সে ধানমন্ডির গ্রীন লাইফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। মগজ বের হয়ে গেছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত টিটুকে আর বাঁচানো গেল না।
গত ২০ জুলাই রাতে টিটু হাওলাদারের ফুফাতো ভাই মো. রাকিব লাশ নিয়ে তার গ্রামের বাড়িতে আসেন। ওই দিন রাতেই জানাজা শেষে স্থানীয়ভাবে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী একজন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। সে তো কোন রাজনীতিতে ছিলো না। তার পরেও বিনা অপরাধে তাকে জীবন দিতে হলো। ছেলে-মেয়ে ‘বাবা বাবা’ বলে হয়রান হচ্ছে। ছেলে সাইমুন বাবার জন্য পাগল ছিলো। ওকে কিছুতেই থামাতে পারছি না। শুধু বাবাকেই খুঁজছে। আমি অবুঝ সন্তানদের কী বুঝ দেব? খাওয়ার মতো ঘরে বাজার নেই। ঢাকায় যাওয়ার সময় আমাকে খালি হাতে রেখে গেছে। ওদের কীভাবে এখন বড় করব, আমি বুঝে উঠতে পারছি না।’
বড় মেয়ে তানজিলা বাড়ির কাছেই আনোর জলিশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ও মেঝ ছেলে সাইমুন স্থানীয় বয়াতি বাড়ি কওমী মাদ্রাসার প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী। বাবা, স্ত্রী ও তিন শিশু সন্তানদের বাড়িতে রেখে টিটু হাওলাদার একাই কর্মস্থলে থাকতেন।
হোসনাবাদ ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো.মাসুদ জানান, টিটু হাওলাদারের রিক্সা চালক বাবা আব্দুর রহিম হাওলাদার এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তাই সবসময় রিক্সা চালানো তার জন্য খুবই কষ্টকর। আর টিটুর চার ভাই বোনের মধ্যে মো. ইমরান হোসেনও রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। এতে তাদের পোষায় না। বলতে গেলে এখন মানুষের দান-দক্ষিণায় চলে টিটুর সংসার। বিবাহিত বড় বোন রুমেনা বেগম (৩৫) থাকেন স্বামীর সংসারে আর ছোট বোন ফাতিমা আক্তার (১৮) প্রতিবন্ধি হওয়ায় বসবাস করেন একই সংসারে।
টিটুর ফুফাতো ভাই রাকিব জানান, পরিবারের কাছে বাড়িতে লাশ নিয়ে আসার মত টাকাও ছিলো না। আমি একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে টিটুর লাশ হোসনাবাদে তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছি। ঢাকা থেকে লাশ বাড়িতে পৌঁছাতে ৪৭ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে আমি ২৭ হাজার টাকা দিয়েছি আর তার শ্যালক হাসান ২০ হাজার টাকা দিয়েছে। সামর্থবান লোকজন ও সরকারের উচিত পরিবারটির পাশে দাঁড়ানো।
বেতাগী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. খলিলুর রহমান খান জানিয়েছেন, তিনি ওই বাড়িতে গিয়েছিলেন। পরিবারটি খুবই অসহায় হয়ে পড়েছে, তাই তাদের সমবেদনা জানিয়ে এসেছি। আমার সাধ্যমতো আমি তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবো।
বরগুনায় সম্প্রতি যোগদানকারী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম ১৯ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার মো. টিটু হাওলাদারের বাড়ি গিয়ে তার কবর জিয়ারত এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন।
এ সময় জেলা প্রশাসক টিটুর পরিবারের হাতে আর্থিক ও খাদ্য সহায়তা তুলে দেন এবং যে-কোনো প্রয়োজনে পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস প্রদান করেন।