বাসস
  ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪:৫২
আপডেট  : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪:৫৮

বাবার জন্যে শিশু সামিরের অপেক্ষা আর ফুরোয় না

॥ এস এম মজিবুর রহমান ॥
শরীয়তপুর, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : প্রতিদিনের মতোই বাবা ‘মজা’ নিয়ে আসবে, আদর করবে। অপেক্ষা করে সামির। কিন্তু বাবা যে আর আসে না। তাই অপেক্ষাও আর ফুরোয় না অবুঝ শিশু সামিরের। চার বছরের অবুঝ শিশুকে সান্তনা দিতে না পেরে মা কেবলই বুকে পাথর বেঁধে গোপনে চোখের পানি মোছেন।
সামির বুঝতেও পারছে না তার বাবা স্বৈরশাসকের পৈশাচিক নিষ্ঠুরতার বলি হয়ে যে অচেনা দেশে চলে গিয়েছে সেখান থেকে আর কখনোই ফিরবেন না। দুই ভাই ও মায়ের কান্না দেখে সামির বাবাকে ফোন করতে যায় তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসতে।
সামিরের এ অপেক্ষা এ জীবনে আর কোনদিন শেষ হবে না। ঢাকার যাত্রাবাড়ি থানার সামনে ৫ আগস্টের বিজয় মিছিলে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত বাস চালক মনোয়ার হোসেন চৌকিদারের তিন ছেলে ও স্ত্রী এখন নিদারুণ অর্থ সংকটে পড়ে মানুষের করুণার পাত্র হয়ে অসহায় জীবন যাপন করছেন।
শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার ফতেজঙ্গপুর ইউনিয়নের শিংহলমুড়ি গ্রামের মৃত আফসার উদ্দিন চৌকিদারের পাঁচ ছেলে মেয়ের মধ্যে চতুর্থ মনোয়ার হোসেন চৌকিদার(৪৫)। মনোয়ার শরীয়তপুর-ঢাকা আন্তঃজেলা বাসের চালক ছিলেন। মনোয়ার হোসেন ও সুফিয়া বেগম দম্পতির তিন ছেলের বড় ছেলে ইমনের বয়স ২০ বছর, মেঝ ছেলে রাকিবের বয়স ১৭ বছর ও ছোট ছেলে সামিরের বয়স চার বছর। বড় ছেলে করোনাকালে ২০২০ সালে এসএসসি পাশ করে এইচএসসিতে ভর্তি হয়ে অর্থাভাবে আর পড়াশোনা করতে পারেনি। মেঝ ছেলে রাকিবও করোনার মধ্যে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করে সমস্যার জন্য আর এগুতে পারেনি। তাই সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম লোকের শহিদ হওয়া মানে কেবল একজনের বিদায় নয়, পুরো সংসারের অনিশ্চয়তা ও হতাশার গহ্বরে ডুবে যাওয়া।
মনোয়ার হোসেনের বড় বোন বিধবা সেলিনা বেগম (৬০) কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, মনোয়ারকে হত্যা করায় শুধু তার স্ত্রী সন্তান নয়, আমাকেও পথে বসিয়েছে ‘খুনি হাসিনা’। আমার ভাই ছিল আমার মাথার উপরের ছাতা। ৩০ বছর আগে স্বামীকে হারিয়ে ভাইয়ের আশ্রয়ে নিরাপদে ছিলাম। কখনো আমাকে অভাব বুঝতে দেয় নাই। আমি এখন কোথায় যাব, কার কাছে আশ্রয় নেব? কে দিবে এর উত্তর? খুনি হাসিনাকে আমার কাছে এনে দেন, তার কাছে এর উত্তর চাই।
মনোয়ারের স্ত্রী সুফিয়া বেগম চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, ইমনের বাবা প্রতিদিন বাস নিয়ে যাত্রাবাড়ি যেতেন আবার রাতে বাসায় চলে আসতেন। ৩ আগস্ট বাস নিয়ে ঢাকায় গিয়ে আর রাতে ফেরেনি। ৪ তারিখে আমাকে বললেন, রাস্তা-ঘাটের অবস্থা বেশি ভাল না, আজ আর আসব না। বন্ধুদের সাথে থেকে যাব। ৫ তারিখ বিকেল পৌনে ৫টায় আমাকে ফোন দিয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে বললেন, যাত্রাবাড়ি থানার সামনে বিজয় মিছিলে ছাত্রদের ওপর পুলিশ মুহুর্মুহু গুলি করছে। আমার জন্য দোয়া করো বলেই ফোন কেটে দিয়েছে। আমি ১০ মিনিট পরে ফোন দিয়েছিলাম, কিন্তু আর ফোন ধরেনি। আমার সাথে শেষ কথা ছিল আমার জন্য দোয়া করো। তার বন্ধু যাত্রাবাড়ির মাছ ব্যবসায়ী শাহজাহান সাড়ে ৫টার দিকে আমাকে ফোন করে জানায় মনোয়ারের বুকে গুলি লেগেছে। ছাত্ররা তাকে পৌনে ৬টার দিকে ভ্যানে তুলে প্রথমে যাত্রাবাড়ি ক্লিনিকে নেয়। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় সেখান থেকে তাকে ঢাকা মেডিকেলে রেফার করে। পরে মনোয়ারের আরেক বন্ধু জাকির ও তার স্ত্রী তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। কিন্তু সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে। জাকির ভাইয়ের কাছ থেকে আমি সংবাদটি পাই। আমার আত্মীয়-স্বজনরা এ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ নিয়ে রাত ১২টার দিকে কোটাপাড়া বাসায় পৌঁছায়। ৬ তারিখ সকাল ৯টায় পশ্চিম কোটাপাড়া জামে মসজিদে ও বেলা ১১টায় নিজ বাড়ি ফতেঙ্গপুর এলাকায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
তিনি বলেন, জেলা শহরের পশ্চিম কোটাপাড়ায় ভাড়া বাসায় প্রায় ২০ বছর যাবত আমার স্বামী, তার বিধবা বড় বোন ও তিন ছেলে নিয়ে বসবাস করছি। এখন তিন মাসের ঘরভাড়াও বাকি পড়েছে। আমাদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা কিভাবে হবে, আর ঘরভাড়াই বা কিভাবে দেব, আর ছেলেদের ও ননদকে নিয়ে কি ভাবে বাঁচব? চোখে এখন শুধুই অন্ধকার দেখছি।


সুফিয়া বেগম আরো বলেন, ‘আমার স্বামী কোন রাজনীতি করত না। ড্রাইভারি করে আমাদের সংসার চালাত। বিএনপির সমর্থক ছিল বলে সবার সাথে বিজয় মিছিল করতে সেখানে গিয়েছিল, এই কি তার অপরাধ? আমি এবং আমার ছেলেদের ভবিষ্যত এখন কি হবে, কে দেবে তার জবাব? ছোট ছেলে সামির প্রতি রাতে বাবার জন্য অপেক্ষা করে, কখন বাবা তার জন্যে ‘মজা’(নানা ধরনের খাবার) নিয়ে আসবে। সামিরকে আমি কিভাবে বুঝাবো তার বাবা আর কোন দিন তার জন্য ‘মজা’ নিয়ে আসবে না। ওদেরকে আমি এখন কি ভাবে বড় করব। আমি এ হত্যার বিচার চাই। খুনি হাসিনা আমার স্বামীকে হত্যা করে আমার পরিবারকে পথে বসিয়েছে। তার বিচারও সরকারের করতে হবে। তাহলেই আমার স্বামীর আত্মা ওপারে শান্তি পাবে।’
সুফিয়া বেগম জানান, এই পর্যন্ত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলাম, শরীয়তপুরের পক্ষ থেকে আমাকে দুই লক্ষ টাকা দিয়েছে। আর জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুব আলম তালুকদার বাস ড্রাইভারদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন। এছাড়া আমি আর কোন সহায়তা পাইনি। সরকারের কাছে আমার দাবি, আমার বড় ছেলেকে একটা চাকুরি বা আয়ের পথ তৈরি করে দেয়ার। যাতে আমরা কোন রকমে বেঁচে থাকতে পারি।
ফতেঙ্গপুর ইউনিয়নের গত ইউপি নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী শাহীন খান বলেন, মনোয়ার হোসেন বিএনপির একজন সমর্থক ছিলেন। ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত পরিশ্রমী ছিলেন। আন্তঃজেলা বাস ড্রাইভার হওয়ায় অনেক বছর আগে থেকেই শরীয়তপুরে ভাড়া বাসায় থাকতেন। তিন ছেলে, স্ত্রী ও বড় বোনকে নিয়ে সুখ স্বাচ্ছন্দ্যেই ছিলেন। এলাকায় বাড়ির জায়গা ছাড়া কোন ফসলি জমিও নেই। মনোয়ার ভাইয়ের মৃত্যুর খবরে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। পরিবারটি এখন উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অসহায় অবস্থায় আছে। আমরা স্থানীয়ভাবে সকলে মিলে অসহায় পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর জন্য চেষ্টা করছি।
মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, মনোয়ার আমাদের দলের একজন সমর্থক ছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবে জেলা বাস মালিক সমিতির মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা মনোয়ারের পরিবারকে দিয়েছি। আমরা দলীয়ভাবেও পরিবারটির জন্য ভালো একটা কিছু করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছি। আমরা সব সময় শহিদ পরিবারটির পাশে থাকব।  
শরীয়তপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: মাইনউদ্দিন বাসস’কে বলেন, আমরা পরিবারটির সবধরনের খোঁজখবর নিয়েছি। ইতোমধ্যে উপজেলার শহিদ মামুনের পরিবারকে উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৪০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছি। মনোয়ারের পরিবারের আর্থিক সহায়তার বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন আছে।
এছাড়া জেলা প্রশাসক মহোদয়ের মাধ্যমে উপজেলার শহিদ পরিবারগুলোর দিকে আমরা সার্বক্ষণিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে রাখব।