শিরোনাম
॥ মাহমুদুর রহমান রনি ॥
বরগুনা, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ (বাসস): বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন হাসিব। কিন্তু তার ডান হাত অচল হয়ে গেছে। ডান হাতে আর কোনদিন কি লিখতে পারবেন তিনি? চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করার স্বপ্ন কী তার অধরাই থেকে যাবে? মেধাবী ছাত্র হাসিবের পরিবারও দুশ্চিন্তায় পড়েছে তাকে নিয়ে।
শারীরিক কষ্ট আর ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায় হতবিহ্বল মো. হাসিব বাসসকে বলেন, ‘আমি মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি। বাঁচার কোনো আশা ছিল না। আমার বন্ধুবান্ধব, বাবা-মা কেউ ভাবেনি আমি বেঁচে ফিরব। আমি বেঁেচ ফিরেছি, কিন্তু পঙ্গু হয়ে গেছি। ডান হাত দিয়ে কাজ করা তো দূরের কথা, কিছু লিখতেও পারি না। রাতে ঘুমাতে পারি না, যন্ত্রণায় শুধু ছটফট করি। জানি না, আমার হাত আদৌ ভালো হবে কিনা।’
অশ্রুভরা কন্ঠে তিনি বলেন, স্বপ্ন ছিলো চিকিৎসক হব। কিন্তু যদি লিখতে না পারি তাহলে কিভাবে ভর্তি পরীক্ষা দেব? আমার চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নটি মনে হয় স্বপ্নই থেকে যাবে।
আমতলী উপজেলার আরপাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের পূর্ব চরকগাছিয়া গ্রামের আবুল বাশার ও মাহমুদা দম্পতির দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে বড় ছেলে মো. হাসিব (২০)। তিনি ২০২২ সালে আমতলী বন্দর হোসাইনিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসা থেকে দাখিল (এসএসসি সমমান) বিজ্ঞান শাখায় জিপিএ ৫ পেয়ে কৃতিত্বের সাথে পাস করেন। এ বছর ঢাকার টঙ্গির তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা থেকে আলিম (এইচএসসি সমমান) পরীক্ষা দিয়েছেন। আলিম পরীক্ষায়ও তিনি জিপিএ ৫ পাবেন বলে আশা করছেন। হাসিবের স্বপ্ন চিকিৎসক হওয়ার। কিন্তু পুলিশের গুলিতে ডান হাত অচল হয়ে যাওয়ায় তার স্বপ্ন আদৌ পূরণ হবে কিনা তা নিয়ে সংশয়ে আছেন।
হাসিব বলেন, সেদিন দাবি আদায়ের জন্য রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছি। এর বেশি কোনো অপরাধ করিনি। কিন্তু পুলিশ আমাদের আন্দোলন দমন করার জন্য নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। গত ১৮ জুলাই বিকেলে আমরা প্রায় কয়েক হাজার ছাত্র উত্তরা বিএনএস সেন্টারের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে বের হই। পুলিশ মিছিলে আমাদের ওপর গুলি চালায়।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ১৮ জুলাই বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে কয়েক হাজার ছাত্র উত্তরা বিএনএস সেন্টার থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিলে মিছিলে পুরো উত্তরা বিএনএস সেন্টার যখন প্রকম্পিত, পুলিশ মারমুখী হয়ে সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়তে থাকে। এ সময় একটি গুলি এসে হাসিবের শ্বাসনালির ডান পাশে লাগে। গুলিটি গলা ভেদ করে ডান ঘাড়ের পেছনের মাংসপেশি ছিঁড়ে বের হয়ে যায়। এ সময় হাসিব অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। মিছিলে অংশগ্রহণকারী ছাত্ররা এবং তার ক্লাসের বন্ধু হোসাইন আলম ধরাধরি করে উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে তার অবস্থার আরও অবনতি হলে রাত ৯টার দিকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসার একদিন পর তার জ্ঞান ফেরে। পঙ্গু হাসপাতালে চার দিন থাকার পর রোগীর চাপ বাড়তে থাকায় চিকিৎসকরা ছাড়পত্র দিয়ে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। এ অবস্থায় কখনো বাড়িতে, কখনো হাসপাতালে থেকে তার চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসায় গলার সামনের অংশ শুকালেও পেছনের ক্ষত এখনও শুকায়নি। গুলিতে ঘাড়ের রগ ছিঁড়ে যাওয়ায় ডান হাতটি অচল হয়ে গেছে।
পঙ্গু হাসপাতালের সহকারি অধ্যাপক ডাঃ মোঃ ফজলুল হক এর অধীনে চিকিৎসা নিয়েছেন হাসিব। তিনি বলেছেন, হাসিবের ডান বাহুতে ক্ষত রয়েছে। হাসিবকে সুস্থ হতে হলে দীর্ঘদিন বিশ্রামে থাকতে হবে। নিয়মিত হাতের থেরাপি নিতে হবে। এক মাস পর তাকে দেখা করতে বলা হয়েছে। একমাস পরেই বোঝা যাবে তার শারীরিক অবস্থা কেমন। পুরোপুরি সুস্থ হতে কত সময় লাগতে পারে সেটিও বোঝা যাবে তখন।
হাসিবের বাবা আবুল বাশার বলেন, ‘আমার ছেলে দেশের মঙ্গলের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রায় মারা গেছিল। আল্লায় বাঁচাইছে। বাঁচলেও ছেলেটার ডান হাত এখন পঙ্গু হয়ে গেছে। আমার ছেলেকে যারা পঙ্গু করছে, বর্তমান সরকারের কাছে তাদের বিচার চাই।’
হাসিবের বন্ধু হোসাইন আলম বলেন, আন্দোলনে গিয়ে আমার বন্ধুর গলায় গুলি লাগে। ও অনেক মেধাবী, লেখাপড়ায় অনেক ভালো। আমার বন্ধুর স্বপ্ন ছিল সে ডাক্তার হবে। একটা গুলিতে তার স্বপ্নটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে এখন। দোয়া করি যেন আল্লাহ ওর স্বপ্নটা পূরণ করে।
হাসিবের বন্ধু ও পরিবার তার সুস্থতার জন্যে সকলের দোয়া চেয়েছে।