বাসস
  ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩:৫২

একমাত্র রোজগেরে জুনায়েদের পঙ্গুত্বে দিশেহারা তার পরিবার

কিশোরগঞ্জ, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ (বাসস):  প্রতিবন্ধী বাবার একমাত্র ছেলে জুনায়েদ। সে এখন পঙ্গু। সংসারে সেই ছিল একমাত্র রোজগেরে ব্যক্তি।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গিয়ে পঙ্গু হয়েছেন কিশোরগঞ্জের হাফেজ জুনায়েদ। প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে অনেক আগেই প্রতিবন্ধী হয়েছেন বাবা। 
কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মহিনন্দ ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে হাফেজ মাওলানা জুনায়েদ আহমেদ (২৫)। অভাব অনটনের সংসারে এই ছেলেটিই ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এখন সেই হয়ে পড়েছে পরিবারের বোঝা। আর তাই দিশেহারা হাফেজ মাওলানা জুনায়েদ আহমেদের পরিবার। তবুও সন্তানের বেঁচে ফিরে আসায় সৃষ্টিকর্তার দরবারে শুকরিয়া জানাচ্ছেন বাবা-মা।
জানা যায়, জুনায়েদ যাত্রাবাড়ি এলাকায় একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করে নিজের ও পরিবারের খরচ চালাতেন। অভাব অনটনের সংসারে পরিবারের একমাত্র রোজগেরে হওয়ায় ছেলেকে নিয়ে বড় আশা ছিল বাবা-মায়ের। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ২৫ বছর বয়সে পা হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে জুনায়েদকে। দেশে যখন বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলছে তখন ঢাকায় আন্দোলনে যোগ দেন জুনায়েদ। সেই দিনের ভয়াবহদুঃসহ স্মৃতির বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।
জুনায়েদ জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন তিনি। সে কারণে আন্দোলনে যোগদান দেন। গত ৫ আগষ্ট দুপুরে শাহবাগ ও গণভবন ঘেরাও করার কর্মসূচিতে যোগদানের জন্য মাদ্রাসার কয়েকজন বন্ধুদের নিয়ে রওনা হোন জুনায়েদ। প্রথমে সাইনবোর্ড এলাকা থেকে যাত্রাবাড়ি পর্যন্ত যান। এসময় সেনাবাহিনী ও বিজিবি তাদের কোন বাধা দেয়নি। এরপর সামনে এগিয়ে কাজলায় পৌঁছালে পুলিশ অতর্কিত হামলা চালায়। সেখান থেকে দফায় দফায় হামলার পর যাত্রাবাড়ি থানা পর্যন্ত পৌঁছালে প্রায় ২টার সময় গোলাগুলি শুরু হয়, এসময় একটি ভ্যানের পেছনে গিয়ে আশ্রয় নেন তিনি। দীর্ঘক্ষণ পালিয়ে থাকার পর বুঝে উঠার আগেই পুলিশ তাদের কাছাকাছি চলে আসে। পুলিশের কাছে মাফ চেয়ে পাশের গলি দিয়ে দৌড় দেওয়ার সাথে সাথে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া শুরু করে পুলিশ। তারাখুব কাছ থেকে গুলি করেছে বলে জানানজুনায়েদ।
তিনি বলেন, এ সময় সাথে থাকা এক বন্ধু নারায়ণগঞ্জের গোলাম রাব্বি বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। আমার বাঁ পায়ের হাঁটুতে গুলি লাগার পর আমি পড়ে যাই। দীর্ঘক্ষণ গোলাগুলির পর স্থানীয় লোকজন ও সহকর্মীরা আমাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে। সেখান থেকে স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে জানা যায় পায়ের দুটো রগ ছিঁড়ে গেছে। অপারেশন করাতে গিয়ে চিকিৎসকদের পরামর্শে আমার পা কেটে ফেলতে হয়। চিকিৎসকরা অনেক চেষ্টা করেও পা রাখার কোন উপায় খোঁজে পাননি।
জুনায়েদ আরও বলেন, আমরা দেশ ও জাতির জন্য যতটুকু সম্ভব করেছি। আমার পা হারিয়েছি। বর্তমান রাষ্ট্র প্রধান আমাদের জন্য কি করবেন তা জানি না। সংসারে আমিই উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। পড়াশোনার পাশাপাশি একটি মাদ্রাসায় টিউশনি করেছি সংসার চালানোর জন্য। বিজয় ছিনিয়ে এনেছি তাতে আমরা সকলেই আনন্দিত। কিন্তু একটি পা হারানোর ব্যথা যে হারিয়েছে সেই বুঝে।
জুনায়েদের পিতা হাবিবুর রহমান বলেন, আমার একটি মাত্র ছেলে। এই ছেলেটা (হাফেজ জুনায়েদ) হলো আমার পরিবারের ভরসার জায়গা। খাওয়া দাওয়াসহ পুরো সংসারের খরচ সেই চালাতো। আমি নিজেও অচল। দীর্ঘ ২২ বছর যাবত প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবন্ধী হয়ে আছি। কোন কাজ করতে পারি না। মানুষ সহায়তা করলে আমার সংসার চলে। না হলে না খেয়ে থাকতে হয়।
হাফেজ জুনায়েদর প্রতিবেশি নিয়ামত উল্লাহ বলেন, জুনায়েদের পরিবার একবারে অসহায়। আল্লাহপাক জানেন ভবিষ্যতে কি অবস্থাতে তাদের দিন যাবে। জুনায়েদ যেই কর্মে ছিল সেখানে থাকলে হয়তো পরিবারটা ঘুরে দাঁড়াতে পারতো। দেশের জন্য সে আন্দোলন করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। বিনিময়ে একটি পা হারিয়েছে। বর্তমান দায়িত্বে থাকা সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ থাকবে জুনায়েদের পরিবারের জন্য এমন কিছু করে দেওয়ার যাতে বাকি জীবনটা সেসুন্দরভাবে চালাতে পারে।
জুনায়েদের সহপাঠি মাহবুব আলম বলেন, দীর্ঘ সংগ্রামের পর শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। এই দেশে শান্তি ফিরে এসেছে। জুনায়েদের অচল হয়ে যাওয়া বিবেচনায় রেখে বর্তমান সরকার ও সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসবে এমনটাই প্রত্যাশা করি। একই সাথে এই আন্দোলনে যারা হতাহত হয়েছেন তাদের ওপর আক্রমণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাই।
সমাজসেবক ও যুবদল নেতা মাসুম বিল্লাহ বলেন, হাসিনা সরকারের পতন নিশ্চিত করতে জুনায়েদের মতো এদেশের হাজারও যুবক আহত হয়েছে। শত শত মানুষ নিহত হয়েছে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই আন্দোলন সফল হয়েছে। তার মধ্যে মহিনন্দ ইউনিয়নের হাফেজ জুনায়েদের পা হারানোতে সকলের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। জুনায়েদ কোন দলের না। সে এদেশের সকল মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছে। সরকার ও ছাত্র সমন্বয়কদের কাছে অনুরোধ তারা যেন জুনায়েদের পরিবারের প্রতি সুদৃষ্টি দেন। কারণ পরিবারটির আর্থিক সহায়তা খুব প্রয়োজন। 
জামায়াতে ইসলামী কিশোরগঞ্জ জেলা শাখার আমীর অধ্যাপক রমজান আলী হাফেজ জুনায়েদ আহমেদের পরিবারকে আর্থিকভাবে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন। পাশাপাশি তার সুচিকিৎসারও আশ্বাস দেন।