বাসস
  ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৫০
আপডেট  : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩:৩৯

‘আমি আর ঘরে থাকতে পারবো না’ মাকে বলা শহিদ জিসানের শেষ কথা

॥ দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ ॥
কুমিল্লা, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ (বাসস): ‘মা তুমি আমারে এত বুঝাও কেন, সবাই বের হয়েছে, আমি আর ঘরে থাকতে পারবো না, আমি গুলি খেয়ে মারা গেলে তুমি শহিদের মা হবা। এত চিন্তা কইরো না।’ ছেলেকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করায় মাকে বলা শহিদ জিসানের এটিই ছিল শেষ কথা।
কুমিল্লার লাকসাম পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা শহিদ আব্দুর রহমান জিসানের মা জেসমিন আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বাসসকে এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, স্বামী বাবুল মিয়া ওয়ার্কশপে কাজ করতো। পরে কাজ ছেড়ে চলে যান দক্ষিণ আফ্রিকা। একমাত্র ছেলে আব্দুর রহমান জিসান এলাকার বিভিন্ন দোকানে ভ্যানে করে ফিল্টারের জার ভর্তি পানি দেওয়ার কাজ করতো। দু’জনের আয় দিয়ে ভালই চলছিল সংসার। এর মধ্যে জিসান বিয়ে করে। আমরা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতাম রাজধানীর যাত্রাবাড়ি থানার রায়েরবাগ এলাকায়।
গত ২০ জুলাই রাজধানীর শনির আখড়ার রায়েরবাগ এলাকায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সংঘর্ষের সময় পুলিশের গুলিতে শহিদ হন জিসান।
জিসানের মা জেসমিন আক্তার আরো বলেন, ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে জিসানের বাবা ২২ জুলাই দেশে আসেন। ছেলের শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এ ঘটনার নয় দিনের মাথায় জিসানের মৃত্যুর শোক সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন তার স্ত্রী মিষ্টি। মাত্র ১৪ মাস আগেই তারা ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। স্বামী অসুস্থ, ছেলে ও ছেলের বউ নাই। আমার সুন্দর সংসার তছনছ হয়ে গেল। পরিবারের উপার্জন করার কেউ নাই। আমি অসহায় হয়ে পড়েছি। শোক সইবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি।
জিসানের দাদী শামছুন্নাহার বলেন, আমার ছেলে বাবুল মিয়া ওয়ার্কশপে কাজ করতো, ধার দেনা করে বিদেশ গেছে। আমার ছেলে আর নাতি মিলে একটু আয় রোজগার শুরু করছিলো। এখন তো সব শেষ। আমার ছেলে অসহায় হয়ে গেল।  
জিসানের আত্মীয় মোঃ আজাদ হোসেন বলেন, জিসানের বাবা বাবুল মিয়া আমার ভাগিনা। সে দেশে আওয়ামী লীগের নির্যাতন ও হামলার কারণে বিদেশে চলে যায়। তার পরিবার ঢাকায় বাসা ভাড়া করে থাকতো। গত ২০ জুলাই যাত্রাবাড়ি এলাকায় ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে সে অংশ নেয়। প্রচন্ড গরমে আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্রদের সে পানি খাওয়ানো শুরু করে। এ সময়ে পুলিশ তাকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। তার চোখ দিয়ে গুলি লেগে পিছন দিয়ে বের হয়ে যায়। অসুস্থ বাবুল মিয়ার ছেলে জিসানই ছিল পরিবারের একমাত্র সম্বল। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বাবুল মিয়া এখন দিশেহারা। মোঃ আজাদ হোসেন অবিলম্বে জিসান হত্যাকারীদের বিচার দাবি এবং অসহায় পরিবারটির পাশে দাঁড়াতে সরকারের প্রতি আহব্বান জানিয়েছেন।
জিসানের বন্ধু নাসির হোসেন, মইন উদ্দিনসহ অনেকে জানায়, জিসান সহজ সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলো। সব সময় ভালো কাজে এগিয়ে যেত। আন্দোলনের প্রতিমূহর্তের খবর সে আমাদের জানাতো। ঢাকায় আন্দোলনের নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বলতো। এভাবে সে নিজেই নির্মমতার বলি হবে ভাবতে পারিনি।
এ ঘটনায় নিহত জিসানের পিতা বাবুল মিয়া বাদী হয়ে যাত্রাবাড়ি থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশের গুলিতে জিসান হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
এ মামলার উল্লেখযোগ্য অন্য আসামিরা হলেন মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকী, সজীব ওয়াজেদ জয়, সালমান এফ রহমান, ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আনিসুল হক, তাজুল ইসলাম, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল-মামুন, সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ।
জিসানের বাবা বাবুল মিয়া বলেন, আমরা স্বামী স্ত্রী বলেও ছেলেকে আটকাতে পারিনি। ছাত্র জনতার গণ-আন্দোলনে সে গিয়েছিলো। সেখানে অন্দোলনকারীদের পানি খাওয়াচ্ছিলো। পুলিশ আমার একমাত্র ছেলেকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আমি বিদেশে ছিলাম। ঘটনার সময় দেশে নেট বন্ধ থাকায় ভাল করে ছেলে হত্যার খবরও শুনতে পারিনি। পরে নাম্বারে কল দিয়ে শুনি ছেলে আর নেই। আমি সাথে সাথে রওনা দেই। ২২ জুলাই দেশে এসে ছেলেকে দাফন করি। আকস্মিক এমন ঘটনা আমি নিতে পারছিলাম না। সাথে সাথে অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। এ বিষয়ে আমি থানায় মামলা করেছি।