শিরোনাম
শফিকুল ইসলাম বেবু
কুড়িগ্রাম, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ (বাসস): এই জানুয়ারিতেই বিয়ে করে সংসার পেতেছিলেন আশিকুর রহমান। লেখাপড়ার পাশাপাশি বাবার কাজে সহযোগিতা করতেন। চেষ্টা করছিলেন চাকুরির। নতুন সংসার। নতুন স্বপ্ন। নতুন আশা। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে প্রতিপক্ষের ইটের আঘাতে সব স্বপ্ন মিছে হয়ে গেলো। সাত মাসের সংসার জীবনের স্মৃতি নিয়ে একা হয়ে গেলেন নব পরিণীতা বিথী খাতুন। পিতা হারালেন তার উপার্জনক্ষম বড় পুত্রকে। দাদি হারালেন মাতৃহীন আদরের নাতিকে।
আশিকের পারিবারিক সুত্রে জানা যায়, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ৪ আগস্ট কুড়িগ্রামে মিছিলে গিয়ে প্রতিপক্ষের ছুঁড়ে দেয়া ইটে মাথায় গুরুতর আঘাত পান আশিক। প্রথমে তেমন কোনো সমস্যা না হলেও অবস্থা ক্রমশ: খারাপ হতে থাকে। প্রথমে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, তারপর ঢাকার গ্রীন লাইফ এবং পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এ নেয়া হয়। দীর্ঘ ২৮ দিন জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে হার মানেন আশিক। গত ১ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান ।
কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার বুড়া-বুড়ি ইউনিয়নের সাতভিটা গ্রামের চাঁদ মিয়ার ছেলে আশিক(২২)। চার ভাই-বোনের মধ্যে আশিক বড়। তিনি পাঁচপীর ডিগ্রী কলেজ থেকে এইচ এস সি পাশ করেন ।
আশিকের ছোট ভাই আতিকুর রহমান বাসসকে বলেন, গত ৪ আগস্ট সকালে আমরা দুই ভাই আলাদা ভাবে কুড়িগ্রাম যাই। ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগের সাথে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার সময় বড় ভাইয়ের সাথে একবার দেখা হয়। শুধু বলেছিলেন, মাথায় ইটের ঢিল লেগেছে। ওর চেয়ে আমি অনেক বেশি মার খেয়েছিলাম। আমার সাথে বন্ধুরাসহ বাসায় এসে চিকিৎসা নিয়ে একটু সুস্থ হই। পরদিন ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলেও আমরা দুই ভাই গিয়েছিলাম। বিজয় মিছিলের দিন ভাই আমাদের এলাকার বাজারে সন্ধ্যায় হঠাৎ বমি শুরু করে। স্থানীয় চিকিৎসক দেখিয়ে বাসায় নিয়ে আসি। কিন্তু সে ক্রমে আরো অসুস্থ হয়ে যায়। কাউকে চিনতে পারে না। চিনলেও কথা বার্তা অগোছালো বলতে শুরু করে। এ অবস্থা দেখে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখান থেকে ঢাকা নিউ লাইফ হাসপাতালে ভর্তি করে পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে ঢাকার বিএসএমএমইউতে রেফার্ড করা হয়। এ সময়ের মধ্যে ছাত্র সমন্বয়ক উমামা, অদিতি আমাদের আর্থিক সহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন। অবশেষে ২৮ দিন পর গত ১ সেপ্টেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভাইয়ের মৃত্যু হয়।
এদিকে স্বামী হারানোর বেদনা আর ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায় বার বার মূর্চ্ছা যাচ্ছেন আশিকের স্ত্রী বিথী। বিথী খাতুন উলিপুর উপজেলার বুড়া-বুড়ি ইউনিয়নের পাইকের পাড়া নিবাসি আবু বকর ও আমেনা বেগম দম্পতির কন্যা। তিনি স্থানীয় জনতার হাট হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী। এ বছর ৭ জানুয়ারি পারিবারিকভাবে আশিকের সাথে বিয়ে হয় তার।
শোকবিহ্বল বিথী খাতুন বাসসকে বলেন, ‘আমার স্বপ্ন, আমার সংসার ভেঙে গেলো! আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেলো। আমি এখন কি করবো?’ হঠাৎই এলোমেলো হয়ে যাওয়া জীবনটা গোছাতে এখন বিথী বেগম নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবেন বলে প্রতিবেদককে জানান। তবে এ বিষয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা চেয়েছেন।
আশিকের বাবা চাঁদ মিয়া বলেন, আমি কার কাছে বিচার চাইবো? আমরা গরীব মানুষ। কুড়িগ্রামে বসে মামলা মোকদ্দমা এখনও করতে পারিনি।
পাঁচ বছর বয়সে মাতৃহারা হন আশিক। এজন্য দাদি ইচিমন বেওয়ার কাছে তার আদর যেন একটু বেশিই ছিলো। নাতি হারানোর শোকে পাথর হয়ে গেছেন ইচিমন বেওয়া। তিনি আশিক হত্যার বিচার চান।
তিনি বলেন, আশিকের সদ্য বিধবা স্ত্রী বিথী বেগম এখন কী করবেন?
জানা যায়, আশিকের পিতা কৃষি কাজের পাশাপাশি ধান পাট কেনাবেচা করে সংসার চালান। পড়ালেখার পাশাপাশি বাবার কাজে সহযোগিতা করে আসছিলেন আশিক। ইচ্ছে ছিলো পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি করে সংসার চালাবেন। এইচএসসি পাশের পর থেকেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য চেষ্টা করছিলেন। কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত হওয়ার তিনদিন আগে চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছিলেন বলে জানান আশিকের ছোট ভাই আতিকুর রহমান।
শহিদ আশিকের বন্ধু রাব্বি ও মজনু জানান, তারা একসাথেই চলাফেরা করতেন। সে খুবই ভালো ছেলে ছিল। সংসারে সে বড়। নতুন বিয়ে করায় তার দায়িত্ব বেড়েছিল। সংসারের হাল ধরতে চাকরি জোগাড় করার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু দূর্ভাগ্য তার সে ইচ্ছে পূরণ হলো না।
পাঁচপীর ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ অজয় কুমার সরকার বলেন, আশিক আমার কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকে বাণিজ্য শাখার ছাত্র ছিল। তার মৃত্যুতে আমরা শোকাহত।
শহিদ আশিকের স্মৃতি রক্ষাসহ পরিবারকে দ্রুত আর্থিক সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করবো আমরা।